একজন বিশ্বনন্দিত নোবেল বিজয়ীর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশ। এটি ভাবতেই রোমাঞ্চিত হচ্ছি। এ অবস্থায় প্রত্যাশিত বৈষম্যমুক্ত মেরিটোক্রেসি ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে সবার অঙ্গীকার এবং সর্বোচ্চ চেষ্টার বিকল্প নেই। এটি জাতির জন্য এক মহাসুযোগ হলেও তা খুবই চ্যালেঞ্জিং। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে সম্মুখসারিতে জীবন বাজি রেখে অংশগ্রহণ পরবর্তীকালে অভ্যুত্থানের প্রত্যয় বাস্তবায়নে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। হতাশ হয়েছি। এবার নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে মৌলিক সংস্কার সাধন এবং সব দুর্নীতির বিচার করতে না পারলে আমরা বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণে আবারো হতাশ হব। আমি যেহেতু একজন শিক্ষক এবং গবেষণার ছাত্র, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার কিছু মতামত শেয়ার করার তাগিদ অনুভব করছি।
আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তির ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন চর্চা করতে পারলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিসহ সব পর্ষদে নিয়োগে বৈষম্যহীন ব্যবস্থা করতে পারব না কেন? আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব প্রতিষ্ঠানে রাজনীতিক প্রভাবমুক্ত মেরিটোক্রেসির চর্চা সর্বাগ্রে শুরু করা আশু প্রয়োজন। মেধাবীকে বঞ্চিত করে অর্থ বা রাজনীতিক বিবেচনায় যত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে তা তদন্ত করে বের করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমি নিজে বাকৃবিতে সব অনুষদে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে কৃষি অনুষদে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েও ৪ বার শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারের পতনের পর থেকে মেধাবীকে বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া ক্রমে বেড়েই চলেছে। ফলে বিশ্বের ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আমাদের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ও স্থান পায়নি। সব স্তরে মেধাহীনদের দৌরাত্ম্য আমাদের এ রকম লজ্জাকর অবস্থানে নিয়ে এসেছে।
দলীয় লেজুরবৃত্তিক ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করে ছাত্রছাত্রীদের নেতৃত্ব তৈরিতে নানা ক্লাব অ্যাক্টিভিটি, ইন্টার্নশিপ এবং অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগে সমস্যা সমাধান ও সম্পদ তৈরিতে উদ্যোক্তা হিসেবে বিকাশের পরিবেশ ও সুযোগ তৈরি করতে হবে।
গত ১৪ বছরকাল বশেমুরকৃবিতে আমার অভিজ্ঞতা এবং প্রায় এক যুগব্যাপী জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের টপ র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষা ও গবেষণায় নিবিড় কর্ম অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার চাইলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকেই সংস্কার শুরু করে সংস্কারের প্রত্যয় দৃশ্যমান করতে পারে। এ কাজ স্বল্প সময়ের মধ্যেই করা যেতে পারে। জনমনে আস্থার জন্য দৃশ্যমান সংস্কার আশু দেখাতে হবে, যা আমাদের মনোসংযোগ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলবে এবং এ সংস্কার কর্মকাণ্ডে জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করবে।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে, ৫ আগস্ট ছাত্র অভ্যুত্থানের পরপরই প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারসহ প্রশাসনিক পদে যারা ছিলেন তারা পদত্যাগ করেছেন কিংবা পালিয়ে আত্মগোপনে আছেন। কেন এমনটি হচ্ছে? প্রাণ ভয়ে?
যা-ই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিরাজমান প্রশাসনিক শূন্যতা আশু পদক্ষেপের মাধ্যমে সমাধান প্রয়োজন। দ্রুত এ শূন্যতা পূরণে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক (দেশে ও বিদেশে অবস্থানরত) এবং গবেষকদের সমন্বয়ে একটি সার্চ কমিটি গঠন করে এক মাসের মধ্যেই সরকারকে সুপারিশ প্রদানের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বমানের শিক্ষা, গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান সৃজন, জ্ঞানের চর্চা এবং জ্ঞানের অনুবাদের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের পথ সুগম করার উদ্যোগ নেয়ার এখনই সময়। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, যথাযথ সংস্কার করতে সক্ষম হলে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আশু বিশ্ব র্যাংকিংয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম। এক যুগের বেশি সময়কাল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান ও জার্মানির টপ র্যাংকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণা অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, মেধা ও মননে আমাদের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী বিশ্বমানের।
আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের স্বার্থে (The University for the Students)। সুতরাং দক্ষ, সমালোচনামূলক চিন্তাবিদ (critical thinkers), উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা গ্র্যাজুয়েট তৈরির জন্য বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন করে বিশ্বমানে উন্নীত করতে একটি কমিশন করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সব অংশীজন, বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করা আবশ্যক।