আদালতের কাঠগড়া কেমন, সেটি আমরা অল্প বয়সেই জেনে গিয়েছিলাম। সেটি বোঝার জন্য আদালতেও যেতে হয়নি। বাংলা সিনেমায় নির্দোষ নায়ককে ফাঁসানোর দৃশ্য দেখেই আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল তা।
আমাদের আইন ও বিচারব্যবস্থা এবং আদালত-কাঠামো সবকিছুই ব্রিটিশদের গড়ে যাওয়া। ঔপনিবেশিক মননে আমরা সেগুলো এখনো বহন করে চলেছি। যে কাঠগড়ার কথা বলছি, সেটিও আবার ব্রিটিশদের সেই আদালত-ব্যবস্থারই অংশ। কিন্তু ব্রিটিশরা যেটি করেনি আমরা সেটিই করলাম—কাঠগড়ার বদলে সেখানে লোহার খাঁচা বসানো। সম্ভবত গত বছরের এই সময়ের আগে-পরে এমন অমানবিক ও নিবৃত্তমূলক পদ্ধতি চালু করা হয়। এটি মনে করে দেওয়ার কিছু নেই যে সেটি ছিল শেখ হাসিনা সরকারের সময়।
এর আগপর্যন্ত নিকট অতীতে আদালতে লোহার খাঁচা আমরা দেখেছিলাম মিসরের ঘটনায়। দেশটির দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসক হোসনি মোবারক ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আদালতে লোহার খাঁচায় পোরা হয়েছিল তাঁকে। পত্রিকার পাতায় ছাপা হওয়া এ দৃশ্য নিশ্চয়ই আমাদের অনেকের মনে আছে।
আবার হোসনি মোবারকের পর দেশটিতে প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারপ্রধান মোহাম্মদ মুরসির ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটেছিল। চলমান আরেক স্বৈরশাসকের আমলে আদালতে লোহার খাঁচার ভেতরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছিলেন। ধারণা করি, স্বৈরশাসন জারি থাকা মিসরের আদালতে এখনো সেই মানবতাবিরোধী ‘কালচার’ চালু আছে।
একটা রাষ্ট্রের বিচার ও আইনব্যবস্থা এবং আদালত-কাঠামো কতটা অমানবিক, সেটা বোঝার জন্য একটা উদাহরণই যথেষ্ট, সেটা হলো, আসামির কাঠগড়ায় লোহার খাঁচা স্থাপন। এ নিয়ে তখন সচেতন নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীদের অনেকে আওয়াজ তুলেছিলেন।
গত বছরের ১৬ অক্টোবর আদালতের এজলাসকক্ষ থেকে লোহার খাঁচার অপসারণ করতে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী। রিটকারী আইনজীবীরা বলেছিলেন, ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ৮৪টি এজলাসকক্ষে লোহার খাঁচা রয়েছে। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রুলও দেন। দেশের কোন কোন আদালতের ভেতরে লোহার খাঁচা রয়েছে, সে বিষয়ে ৬০ দিনের মধ্যে আইনসচিবকে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে, সেই প্রতিবেদন আর দেওয়া হয়নি।
শেখ হাসিনা সরকার সব সময় বলত, আইন ও আদালতে তারা কোনো হস্তক্ষেপ করে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা তারা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু যেসব প্রতিষ্ঠান গত ১৫ বছরে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বিচার বিভাগও। তাদের বিরোধীদের এই অভিযোগ তো সবারই জানা, আওয়ামী লীগ সরকার দেশে বিচারব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
যা-ই হোক, দেশের বিচার বিভাগকে যেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বা আজকের বিচার বিভাগ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার একটি বড় নমুনা হতে পারে, আদালতে লোহার খাঁচা স্থাপন এবং সেটি এখন পর্যন্ত বহাল থাকা। একজন মানুষ যত বড়ই অপরাধী হোক না কেন, তার মানবিক মর্যাদাকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই। অথচ সেই মানবিক মর্যাদার চূড়ান্ত হানিকর এই লোহার খাঁচা।
বিচার ও দণ্ড সম্পর্কে রক্ষণবিষয়ক সংবিধানের ৩৫ (৫) অনুচ্ছেদে আছে, ‘কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার করা যাবে না।’
এটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার সনদ, ইন্টারন্যাশনাল কভন্যান্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটসেরও (আইসিসিপিআর) পরিপন্থী। বাংলাদেশ ওই সনদের স্বাক্ষরকারী দেশ। এ সনদের ৭ নম্বর ধারা আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৫ (৫)-এর অনুরূপ।