প্রায় ৫০ বছর হতে চলেছে, এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দুই কন্যাসন্তান ব্যতীত সপরিবারে কিছু ঘাতকের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন।
ঘাতক দল ও তাদের সহযোগী এবং এই হত্যাকাণ্ডের সুবিধাভোগীরা শুধু তাঁকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি; মানুষের মন থেকে তাঁকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য যা যা করা দরকার, কোনো কিছু থেকেই বিরত থাকেনি। মানুষের জীবনের প্রতিদিনের চিন্তাভাবনা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে তাঁর অস্তিত্ব বিলীন করার সব কৌশল অবলম্বন করে তারা। এদের দ্বারা দুই দশক ধরে ইতিহাস বিকৃতির চরম উদাহরণ প্রত্যক্ষ করে সাধারণ মানুষ।
সামাজিক সংস্কৃতি-শিক্ষা ব্যবস্থায় ধীরে ধীরে কিন্তু অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অনুপ্রবেশ করানো হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধ্যান-ধারণা, যা স্পষ্টত প্রশ্রয় পেতে থাকে রাষ্ট্র পরিচালকদের কাছ থেকে। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মতো একটা নিকৃষ্ট ঘটনার প্রতি জনগণের যে কোনো রকম নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে এবং নিজেদের কৃতকর্মের দায় থেকে বাঁচাতে নৈতিক ও আইনগত প্রতিরক্ষা নিতে গিয়ে ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ব্যতীত দেশ রক্ষা করা যেত না’– এ কথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নানান কুৎসা রটনার অপকৌশল নিল।
কোনো সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা করার অনেক পরিস্থিতিই তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামল তার ব্যতিক্রম ছিল, এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু তাঁকে হেয় করতে গিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে এ দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে তাঁর দীর্ঘদিনের অনন্য অবদান, তাঁর ত্যাগ-তিতিক্ষা, সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁর আন্দোলন-সংগ্রাম, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বকে পর্যন্ত তারা অস্বীকার করতে শুরু করে। এ দেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে তারা এ দেশের মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কেও মানুষের মনে ভুল ধারণা প্রোথিত করতে থাকে। প্রতিটি স্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরোধিতা করা লোকজনকে প্রতিষ্ঠিত করে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। বাংলাদেশকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে ‘দায়মুক্তি’ আইন করে হত্যাকাণ্ডের জন্য নিজেদের বিচারের আওতার বাইরে রাখার ব্যবস্থা করে।
পরে অবশ্য জনগণের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের ফলে সাম্প্রদায়িক সামরিক স্বৈরাচারের পতন ঘটে এবং দেশে নির্বাচনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়। আমরা এই পরিবর্তনকে অভিহিত করলাম ‘গণতন্ত্রের অভিযাত্রা’ বলে।
অনেক আশা-প্রত্যাশা, নিরাশা, হতাশার মধ্য দিয়ে প্রায় ৩৫ বছর কাটল জাতির। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরিচালিত হবে– সেটাই সর্বজনগ্রাহ্য হওয়া উচিত। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ তো কোনো একক ব্যক্তির চিন্তা বা শখ থেকে তৈরি হয়নি। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে নানা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা নির্মাণ করেছে। মানুষ সে জন্য প্রাণ দিয়েছে।