গত ৫ আগস্ট ছাত্রছাত্রী ও সাধারণ মানুষের বিজয়োল্লাসের বাঁধভাঙা স্রোত সারা দিন ধরে দেখেছি। কারও আনন্দোল্লাসকে বিঘ্নিত করতে চাই না। চাই এদেশের বিজয়োল্লাসকে স্থায়িত্ব দিতে। আমি কবি নই। তবুও ছোটবেলায় একটা কবিতার পঙ্ক্তি লিখেছিলাম এমন : ‘একটুখানি খ্যাতি হলে খ্যাতির ভারে নুয়ে, চলার পথে পিছলে পড়ে ঠেকায় মাথা ভুঁইয়ে’। বারবার এমনটিই হয়। তাই সময় থাকতে ‘সাধু সাবধান’!
রাষ্ট্র ও সমাজ সংস্কারের কথা পতিত সরকারের সময়ে শত হুমকির মুখেও এ পত্রিকায়ই বারবার লিখেছি; আবারও লিখতে হচ্ছে। অনেকেই এ বিজয়কে দ্বিতীয় স্বাধীনতা, কেউবা দ্বিতীয় বিজয় দিবস বলে আখ্যায়িত করছেন। আমি কিন্তু এ আন্দোলনের বিজয়ে একটা সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিপ্লবের সুগন্ধ খুঁজছি। দীর্ঘদিনের এত প্রাণের ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ বিজয়কে নিঃসন্দেহে বিপ্লব বলতে পারি। বিপ্লব দেশ ও সমাজে আমূল পজিটিভ পরিবর্তন আনে। এটাই বড় চাওয়া। শরতের প্রবল বৃষ্টি যেমন জমে থাকা আবর্জনা ও কর্দমাক্ত পরিবেশকে ধুয়ে-মুছে দিগন্তবিস্তৃত রোদ্দুর-করোজ্জ্বল আলোর ছটায় ঝকঝকে-তকতকে করে শুচিশুদ্ধ করে, এ অর্জন সেপথে ধেয়ে চলুক এটা এদেশের আপাতত নাগপাশমুক্ত দীর্ঘ-বছর লালিত মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশা।
স্বাধীনতার পর থেকে বারবার বিজয়ের কথা আমরা মুখে মুখে অনেকবার বলেছি। কিন্তু বিজয়ের ফলে হাতে-পাওয়া মুক্তির আলোকমালা কেন জানি না বারবার হাত থেকে ফসকে গেছে। মুক্তিপিপাসু মনের একান্ত চাওয়া সুদূরপরাহত হয়ে গেছে। ভুগতে হয়েছে দেশ ও সমাজকে। আমাদের দেশ ও সামাজিক অবস্থা পেছাতে পেছাতে ক্রমেই অগণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা, অমানবিকতা, ডাহা মিথ্যাচারিতা, লুটপাট ও অপকর্মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে।
ছোটবেলায় গ্রামের পরিবেশে বিস্কুট খাব বলে মায়ের কাছে কান্নাকাটি করতাম। মা একটা বিস্কুট এক হাতে দিয়ে খেতে বলতেন। বিস্কুটটা দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে আবারও কাঁদতাম, দুই হাতে দুটি বিস্কুট চাই। অবশেষে মা এসে ছুড়ে ফেলা বিস্কুটটা কুড়িয়ে এনে উলটো দিকে ঘুরে ওই বিস্কুটটাকে দুই ভাগ করে দুই হাতে দিয়ে চলে যেতেন। তখন দু’হাতে বিস্কুট পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠতাম। জটিল বুদ্ধিটা মাথায় খেলত না।
এখন জীবনের এই পড়ন্ত বিকালে এসে এদেশের ‘অতি মহান’ রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝতে শিখেছি। শুধু অনুশোচনায় লিখে চলি : ‘দিনগুলি আমার হারিয়ে গেল ঐ সুদূরের স্বপ্নালোকে, ব্যথিত তাই আমার এ হৃদয় হারানো সেই দিনের শোকে।’ সমাজের কদাকার রূপ, প্রতারণা, মুখে মধু পেটে বিষ, শোষণের সব কৌশল, ভাঁওতাবাজি করে লুটপাট- সবই বোঝার ক্ষমতা বিধাতা এ সমাজের ভুক্তভোগীদের দিয়েছেন। এবার শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না, আমি কর্মে বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। কোনো দলের সামনের কাতারে গিয়ে অতি উৎসাহ দেখিয়ে দড়ি ধরে গলা ফাটিয়ে কারও পক্ষে স্লোগান হাঁকতেও আমি নারাজ। প্রতারণা, মিথ্যাচার বর্তমানে স্বার্থবাদী লোকের আদর্শ ও মূলনীতি। এই একটা কারণেই এদেশের মানুষ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে বারবার প্রতারিত হচ্ছে। আমরা সাধু হই না, স্বার্থের কারণে সাধু সাজি। কত হীন-স্বার্থপর লোক যে ভোল পালটে সবার সামনে সাধু সাজতে এখন আসবে, তাকিয়ে দেখলেই ঘৃণায় মনটা রি রি করে উঠবে।
আমি দেশ ও সমাজের পরিবর্তন চাই। অনেক হয়েছে, আর নয়। এক দলসহ চৌদ্দ দলের পতন নিশ্চিত হয়েছে। আরও শতেক দল আছে। আমি আমার লেখার মাধ্যমে দেশ ও সমাজের সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিতে চাই। লিখিত সংস্কার চাই। দেশ ও সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। তাই আগে রাষ্ট্রপরিচালনার নীতি পরিবর্তনের ও সংস্কারের কথা ভাবতে হবে। সংস্কারের এ সুযোগ এবার হাতছাড়া হয়ে গেলে দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নতি ও স্বাধীনতা ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে। আবার সেই পুরোনো খেলার পুনরাবৃত্তি হবে। এবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ কমপক্ষে ৫ বছর হোক এটা আমার চাওয়া।
এদেশের সব দলের রাজনীতিকদের অনেককেই আমি চিনি। প্রতিটি দলেই অল্প কিছু লোক এখনো ভালো আছেন। এছাড়া উপর থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বেশিরভাগ নেতাকর্মীর রাজনীতিক হওয়ার উদ্দেশ্য জনসেবা ও দেশসেবা, আত্মত্যাগের জন্য আদৌ নয়। কথাটা আমার একটুও বাড়িয়ে বলা নয়। এ সমাজ যে পরিবর্তনযোগ্য নয়, আমি তা বিশ্বাস করি না। আমাদের এ ছাত্রসমাজকে দিয়ে দেশ ও সমাজ উন্নয়নের অনেক কিছু করার আশা আবার জেগেছে। প্রয়োজন সুস্থ ও সাবলীল উদ্দেশ্যভিত্তিক জবাবদিহি নেতৃত্ব। এই ছাত্রদেরকেই রামদা, কিরিচ, চাপাতি হাতে দিয়ে, কখনো পিটিয়ে অন্য ভাইকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে হত্যা করার অনেক বাস্তব ঘটনা আমরা দেখেছি। আবার এদেরই একটা বড় অংশকে দেশের প্রয়োজনে, মানুষের প্রয়োজনে সাহায্যের ডালি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখেছি।
সামাজিক পরিবেশ কেমন হবে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মানসিকতার ওপর। আমাদের দেশে সব অন্যায়, দুর্বৃত্তায়ন, বিকৃত মানসিকতা ও অপকর্মের জননী দিগ্ভ্রষ্ট রাজনীতিকরা। এদের কোনো দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতা নেই, জিহ্বারও কোনো মূল্য নেই। যত দুর্বৃত্তের আস্তানা ও আশ্রয়দাতা এদেশের রাজনৈতিক দল। এসব কথা লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হয়ে গেছে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, দলবাজি মুক্ত করার একটাই পথ-দলমত নির্বিশেষে স্বার্থপর, দেশ বিক্রেতা, মতলববাজ লোকদের কোনোভাবেই ক্ষমতার আসনে না বসানো, আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করা।