গণ-আন্দোলনের অনেক ঘটনাবহুল দীর্ঘ এক মাস পর মাত্র দুই দিন আগে একটি নির্দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। দেশ পরিচালনায় যখন যে সরকারই আসুক, তাদের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকে। এই অন্তর্বর্তী সরকারেরও আছে; বরং একটু বেশিই আছে। কারণ রাষ্ট্র ও সমাজে দীর্ঘকাল ধরে জমে ওঠা অনেক জঞ্জাল তাদের সাফ করতে হবে, যাকে রাষ্ট্রের সংস্কারও বলা যায়। এটিই হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। একইভাবে দেশের জন্য তাদের অনেক কিছু অর্জন করারও আছে। জঞ্জালগুলো সাফ না করে সেই অর্জন সম্ভব হবে না।
আমাদের যুগ যুগের অভিজ্ঞতা হলো, প্রচলিত ধারার কোনো রাজনৈতিক দল বা শক্তি এই জঞ্জালগুলো কোনো দিনই কার্যকরভাবে পরিষ্কার কিংবা অপসারণ করে না। তারা যেটুকু করে তা একপেশে, নিজেদের গা বাঁচিয়ে করে। তাতে রাষ্ট্রব্যবস্থার কিংবা দেশের কোনো লাভ হয় না। এ জন্যই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক বেশি। সেই প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য সময় দরকার। কাজেই সাধারণভাবে অন্তর্বর্তী সরকার বলতে যেমন ধারণা করা হয় যে স্বল্পকালীন কয়েক মাসের একটি সরকার, যার প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেওয়া, এবার তেমন হলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আাবার সেই পুরোনো ধারাই বহাল হবে এবং চালু থাকবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকালটা যত দীর্ঘ হবে, ততই ভালো।
দেশবাসী দেখেছে, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পরই গণভবনে গণলুটপাট হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, জাতীয় সংসদ ভবন এবং আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়েছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভস্মীভূত করা হয়েছে। এসব জায়গার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব ছিল। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার কারণে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় ও সহায়-সম্পদের ওপরও হামলা এবং লুটপাট চালানো হয়েছে। এগুলো দুঃখজনক ও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।
এই সব ঘটনার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে একটি বার্তা পৌঁছেছে। সে বার্তাটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নির্বাসনে পাঠানোর সেই পুরোনো ধারা প্রতিষ্ঠার, যা ১৯৭৫-পরবর্তী সময়েও করা হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রচ্ছন্ন ছত্রচ্ছায়ায় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘৃণিত অতীত পুনঃপ্রতিষ্ঠার বার্তা গেছে দেশবাসীর কাছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম দায়িত্বগুলোর একটি হচ্ছে, শুধু কথায় নয়, কাজের মাধ্যমে এসব ঘটনাবলি সম্পর্কে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করা। একই সঙ্গে দেশবাসীর কাছে পৌঁছানো বার্তাটি যে ভুল, তা প্রমাণ করা এবং ভেঙে পড়া আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি এবং লুটপাট ও নাশকতার ঘটনাবলির নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করাও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। অন্যথায় অন্তর্বর্তী সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে আস্থার অভাব দেখা দেবে। যদিও গত দু-তিন দিনে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনীর প্রধান স্পষ্ট করেই বলেছিলেন যে তিনি, অর্থাৎ সেনাবাহিনী দায়িত্ব নিচ্ছেন। সে হিসেবে প্রাথমিক পরিস্থিতি সামলানোর দায়িত্ব তাঁদেরই ছিল। তবে এই সময়ে পুলিশ বাহিনী দায়িত্ব পালনে বিরত থাকায় সেনাবাহিনীর পক্ষে যে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি, তা অবশ্য সেনাপ্রধান ব্যাখ্যা করে বলেছেন। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার যেটি গঠিত হয়েছে, সেখানে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নেই। তবে রাষ্ট্রীয় জঞ্জাল সাফ করার যে কথা আগে বলেছি, তা করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল দীর্ঘতর করতে হলে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করতে হবে।