ডায়াবেটিস একটি দীর্ঘমেয়াদি বিপাকীয় রোগ। এ রোগে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখও, বিশেষ করে চোখের নিউরো-সংবেদনশীল রেটিনা। রেটিনার রক্তনালি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি নামক একটি রোগ হয়, যা নষ্ট করে দিতে পারে আমাদের দৃষ্টিশক্তি। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে রেটিনার অংশে সরু রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে এক ধরনের তরলের ক্ষরণ শুরু হয়। এতে দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এর পরবর্তী পর্যায়ে রক্তনালিগুলোতে রক্ত চলাচলের সমস্যা আরও বেড়ে যায়। ফলে রেটিনার বিভিন্ন অংশে ঠিকমতো অক্সিজেন পৌঁছতে না পেরে চোখের ভিট্রিয়াস গহ্বরে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এ অবস্থাকে বলা হয় ভিট্রিয়াস হেমারেজ। এর থেকে অন্ধত্ব আসতে পারে। চোখের যেসব অসুখের কারণে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি তার অন্যতম। বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক রোগীদের মধ্যে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাব অনুমান করা হয় ২৭ শতাংশ। জনসংখ্যাভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণায়/সমীক্ষায় বাংলাদেশে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীদের মধ্যে রেটিনোপ্যাথির প্রাদুর্ভাবের হার দেখা গেছে ৩০ শতাংশের বেশি।
প্রকারভেদ : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির দুটি প্রধান ধরন রয়েছে-নন-প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (এনপিডিআর) এবং প্রলিফেরেটিভ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (পিডিআর), যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির একটি গুরুতর রূপ। এনপিডিআর ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রাথমিক পর্যায়ে রেটিনার রক্তনালিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে, দেখা যায় রেটিনায় রক্তসংবহনে (ভাস্কুলার) ব্যাপ্তিযোগ্যতা, মাইক্রোএনিউরিজম (রক্তনালির স্থানীয়ভাবে স্ফীত হওয়া) গঠন এবং চোখের ভেতরে রক্তরস ও রক্তক্ষরণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির পূর্বপর্যায় হচ্ছে ‘পিডিআর’, যেখানে দেখা যায় রেটিনা স্তরের ইনফ্রাক্ট (রক্তপ্রবাহ বন্ধ হওয়ায় চোখের স্ট্রোক), অস্বাভাবিক নতুন রক্তনালিকা প্রসারণ, নতুন রক্তনালিগুলোর ভঙ্গুরতা এবং চোখের ভেতরে রক্তপাত (ভিট্রিয়াস হেমোরেজ)। এটি রেটিনাল ডিটাচমেন্ট এবং রক্তক্ষরণজনিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
প্রধান যে ফ্যাক্টর দায়ী : ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি বিকাশের জন্য সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক ঝুঁকির কারণ হলো স্বাভাবিক গ্লাইসেমিক নিয়ন্ত্রণ। ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি রেটিনার রক্তনালিগুলোর একটি রোগ (মাইক্রোভাস্কুলোপ্যাথি) হিসাবে স্বীকৃত। সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলো রেটিনায় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে সাহায্য করে। রক্তনালিগুলোর বর্ধিত ব্যাপ্তিযোগ্যতার পাশাপাশি দেখা যায় রক্ত-রেটিনা প্রতিবন্ধকের (বিআরবি) ভাঙন এবং রেটিনার স্নায়ুকোষ, এন্ডোথেলীয় কোষ ও পেরিসাইটের অ্যাপোপটোটিক মৃত্যু, সেই সঙ্গে মাইক্রোএনিউরিজম ও নিউক্লিয়াসবিহীন অকোষীয় রক্তনালির উপস্থিতি।
যেহেতু পেরিসাইটগুলো রক্তনালির জন্য কাঠামোগত সহায়তা প্রদান করে, তাই তাদের ক্ষতির ফলে রক্তনালির প্রাচীরে স্থানীয়ভাবে স্ফীত (মাইক্রোএনিউরিজম) হতে দেখা যায়, যা ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির প্রথমদিকের ক্লিনিক্যাল লক্ষণ। পেরিসাইট ও এন্ডোথেলীয় কোষের ক্ষতির ফলে স্বাভাবিক রক্তসঞ্চালনে বাধা বা রেটিনাল ইস্কেমিয়া হয়, যা হাইপোক্সিয়াকে (কম অক্সিজেন পারফিউশন) প্ররোচিত করে। ফলে ভাস্কুলার এন্ডোথেলীয় গ্রোথ ফ্যাক্টরের সংশ্লেষণও বৃদ্ধি পায়। ভেইজেফ হলো একটি সংকেতবাহী গ্রোথ ফ্যাক্টর বা প্রোটিন, যা টিস্যুতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য বিদ্যমান রক্তনালি থেকে নতুন রক্তনালি সৃষ্টি করে। এ পদ্ধতিকে বলা হয় নিওভাসকুলারাইজেশন।
অন্যান্য রিস্ক ফ্যাক্টর : স্থূলতা : প্রত্যেক মানুষের ওজন নির্ভর করে তার উচ্চতার ওপর। পূর্ণবয়স্ক মানুষের ওজনাধিক্য ও স্থূলতা নিরূপণের জন্য উচ্চতা ও ওজনের যে আনুপাতিক হার উপস্থাপন করা হয়, তাকে ‘বডি মাস ইনডেক্স’, সংক্ষেপে ‘বিএমআই’ বলে। বিএমআই ছাড়াও কোমর ও নিতম্বের মাপের অনুপাত দিয়েও ওজনাধিক্য ও স্থূলতা নিরূপণ করা যায়। এ সূচক দুটি বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যঝুঁকি যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগের পাশাপাশি পুষ্টির ঘাটতির পরিমাপের একটি সূচক।
উচ্চরক্তচাপ : উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির একটি গুরুত্বপূর্ণ ঝুঁকির কারণ। বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও এর প্রমাণ মিলেছে। এছাড়া কিছু জনসংখ্যাভিত্তিক গবেষণায় দেখানো হয়েছে, মূলত সিস্টোলিক রক্তচাপ ধারাবাহিকভাবে ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথির সঙ্গে যুক্ত। ডায়াস্টোলিক রক্তচাপের সঙ্গে এ রোগের কোনো উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক পাওয়া যায়নি। টাইপ ২ ডায়াবেটিসে ‘রেনিন-অ্যাঞ্জিওটেনসিন সিস্টেম’র রেটিনোপ্যাথি অবরোধেও নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে, যেখানে এটি মাইক্রো/ম্যাক্রোঅ্যালবুমিনুরিয়াসহ নেফ্রোপ্যাথি ও হৃদসংবহন রোগের ঝুঁকিও হ্রাস করতে দেখা গেছে।