পেশাগত কাজের কারণে এখন আর সেভাবে কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যাওয়া হয় না। আড্ডাটাও আর আগের মতো দেওয়া হয় না প্রিয়জনদের সঙ্গে। কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখনো আমাকে মিডিয়া আর ফেসবুকের মধ্য থেকে এই আন্দোলনের খবর নিতে হয়েছে। এরপরও ৩ আগস্ট শনিবার (আমার অফিসের ছুটির দিন ছিল) শিক্ষার্থীদের ডাকা সমাবেশে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। এই প্রথম অনেক দিন পর কোনো রাজনৈতিক সমাবেশে আমার যাওয়ার অভিজ্ঞতা। সেদিনই কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতারা এক দফা দাবি পেশ করেন। এক দফা দাবি ছিল শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করতে হবে। সেদিন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে লাখের কাছাকাছি শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সের এবং নানা সামাজিক অবস্থানের শ্রেণি-পেশার মানুষ উপস্থিত হয়েছিল। আমি লক্ষ করেছি, সরকারের আর কোনোভাবেই ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নেই। মানুষের মুখের ভাষাই বলে দিচ্ছে তারা আর শেখ হাসিনাকে চায় না। জনরোষ কাকে বলে, সেটাই সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম।
৩ আগস্ট আমার কাছে স্পষ্ট হয় সরকারের পতন মাত্র কয়েক দিনের বাকি। আমি জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমার মন বলেছিল শেখ হাসিনা কোনোভাবেই আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। কারণ সরকার ১৫ বছরে রাজনীতির শিষ্টাচার চরমভাবে লঙ্ঘন করেছে। বিরোধী মত বলতে কিছু ছিল না। মানুষ মুক্তভাবে কথা বলতে পারেনি। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টসহ নানা ধরনের দমন আইন করে মানুষের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। এরপর সীমাহীন লুটপাট এবং দুর্নীতি করে দেদার টাকা পাচার করা হয়েছে। এ ধরনের টাকা পাচার স্বাধীনতার পরে আর কোনো সময়ে করা হয়নি। খেলাপি ঋণের কারণে ব্যাংক খাত দেউলিয়া হয়েছে। আর ধারাবাহিকভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলার-সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে আছে। পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতির কারণে সাধারণ মানুষের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ে। সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ জনগণের মন থেকে সরকার একধরনের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সরকারসহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি সাধারণ জনগণের আস্থা যে চলে গেছে, সেটা কোনোভাবেই উপলব্ধি করতে পারেননি।
এসবের মধ্যে দেশের কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট জনগণের দুর্দশা উপলব্ধি করে কর্মসূচি হাজির করে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। প্রধান বিরোধী দলও জনগণের দাবি নিয়ে সেভাবে জোরালো কর্মসূচি দেয়নি। এভাবে দেশে একটা নীরবতার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। মানুষ বিক্ষুব্ধ ছিল, কিন্তু কেউ কোনো আশার আলো দেখাতে পারেনি। এর পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন। প্রথম থেকেই এই আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদেরই আন্দোলন ছিল। একসময় সরকারের কার্যকর ভূমিকার অভাবে আন্দোলনটি ভিন্ন মাত্রা পায়। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ ও ছাত্রলীগের আক্রমণের কারণে সাধারণ জনগণ তাঁদের পক্ষে অবস্থান নেয়। একসময় আন্দোলনটি ছাত্র-জনতা বনাম সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তি শিক্ষার্থীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।
এক দফা আন্দোলন ঘোষণার পরের দিন ৪ আগস্ট আবারও সারা দেশের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। শেখ হাসিনার আলোচনার প্রস্তাব আন্দোলনকারী নেতারা বাতিল করে দেন। এই পরিস্থিতিতে আন্দোলনকারী নেতৃত্ব ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
এই কর্মসূচিই নির্ধারণ করে দেয় আন্দোলনে জয়-পরাজয় কোন জায়গায় পৌঁছাবে। দুই পক্ষই জয়ী হওয়ার মরণপণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। অবশেষে শেখ হাসিনা পিছু হটে পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করেন।
শেখ হাসিনার পতনের পরই সারা দেশের মানুষ বাঁধভাঙা আনন্দের জোয়ারে ভাসতে থাকে। দীর্ঘদিন পর মানুষ যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল। আনন্দ-উৎসবে সারা দেশের মানুষ মেতে উঠেছিল। এ রকম অবস্থায় পুলিশ প্রশাসন বলতে দেশে কিছু ছিল না।