শহীদ শামসুজ্জোহাকে যেভাবে দেখেছি

বণিক বার্তা প্রফেসর ড. আবদুল খালেক প্রকাশিত: ৩০ জুলাই ২০২৪, ১০:০৩

সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার খবর প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মতো রাজশাহীর জনসাধারণও প্রচণ্ড ক্ষোভে ফেটে পড়ে। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য স্থানীয় প্রশাসন রাজশাহী শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রছাত্রী ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আইয়ুব খানের দালাল হিসেবে পরিচিত রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষের বাসার সামনে সমবেত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। পুলিশের সঙ্গে একপর্যায়ে ছাত্রদের সংঘর্ষ বাধে। ড. জোহা খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে দ্রুত ছুটে যান ঘটনাস্থলে। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কয়েকজন ছাত্র তখন আহত। খবরটি ক্যাম্পাসে প্রচার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান তথা এসএম হলের প্রভোস্ট ড. মযহারুল ইসলামও ঘটনাস্থলে চলে যান। আহত ছাত্রদের ড. জোহা ও ড. মযহারুল ইসলাম গাড়িতে তুলে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান চিকিৎসার জন্য। আহত ছাত্রদের ফোঁটা ফোঁটা রক্তে শিক্ষকদের জামা ভিজে ওঠে। এ ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৫টার ঘটনা। ১৯৬৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর ‘গতকাল রাজশাহী গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনের নিকট ছাত্রদের এক মিছিলের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপের ফলে ১০ জন ছাত্র আহত হয়। ইহাদের মধ্যে ৪ জনের অবস্থা গুরুতর। ...মিছিলকারীরা গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যক্ষের বাসভবনের দিকে অগ্রসর হইতে থাকিলে একদল পুলিশ তাহাদের গতিরোধ করে। ইহাতে মিছিলকারীরা বিক্ষুব্ধ হইয়া পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছুড়িতে থাকিলে পুলিশ তাহাদের উপর লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করিতে থাকে। ইহার ফলে ১০ জন আহত হয়। তাহাদের মধ্যে ১০ জনই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আহত সকল ছাত্রকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ও গ্রেফতার করা হইয়াছে।’ আহত ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শামসুল হক টুকু (বর্তমানে ডেপুটি স্পিকার) মু. আজহার আলী (বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রফেসর)। তিনি বলেছেন, ‘মিছিলটি দ্রুত রাজশাহী কলেজের তৎকালীন প্রিন্সিপাল আবদুল হাই সাহেবের বাসার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। মিছিল স্টার স্টুডিও অতিক্রম করার পূর্বেই বেশকিছু দাঙ্গা পুলিশ আমাদের পিছু নেয়। এ সময় সবার মধ্যে প্রবল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এ সময় পেছন থেকে প্রায় শতাধিক দাঙ্গা পুলিশ মিছিলে লাঠি চার্জ করে। পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করেও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। আমরাও পুলিশের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকি। প্রায় ২০ মিনিটব্যাপী ধাওয়া ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপ চলার পর আমরা ক’জন পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। পুলিশ নির্মমভাবে আমাদের প্রহার করে। আমাদের পুলিশ ভ্যানে ওঠানোর পর একজন পুলিশ রাইফেলের বাঁট দিয়ে শামসুর রহমানের চোয়ালে খুব জোরে আঘাত করলে তার মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে থাকে। ঠিক এ মুহূর্তে সাদা শার্ট ও সাদা প্যান্ট পরিহিত ড. শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। ড. জোহা দ্রুত তার গাড়ি থেকে নেমে পুলিশের মুখোমুখি হন এবং অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, ‘ইউ ব্রুট, ভ্যানে তুলেও তোমরা ছেলেদের মারছ’। আমাদের ভ্যানটি যখন থানার উদ্দেশে ছেড়ে যাবে তখন ড. জোহা পুলিশ ভ্যানে উঠে পড়েন। ড. জোহা পুলিশ ভ্যানের বেঞ্চে বসে পড়েন।’


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগ থেকে ১৯৬৯ সালে একুশের অনুষ্ঠান পালন উপলক্ষে এক সপ্তাহের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয় শহীদুল্লাহ কলা ভবনের সামনে তৎকালীন শহীদ মিনারের পাদদেশে। ১৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যা রাতে বাংলা বিভাগ আয়োজিত সেমিনারে যে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, শহরে ছাত্রদের আহত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা বিভাগের আলোচনা সভা শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদ সভায় রূপান্তরিত হয়। ড. মযহারুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন নেতৃস্থানীয় প্রায় সব শিক্ষকই (ড. জোহা, অধ্যাপক হবিবুর রহমান (শহীদ), অধ্যাপক কাজী আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক প্রমুখ) ছাত্রদের প্রতি নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন এবং কঠোর ভাষায় তৎকালীন সরকারের সমালোচনা করেন। ড. জোহা এ সভায় তার শার্টে ছাত্রদের রক্তের দাগ দেখিয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন ‘আহত ছাত্রদের পবিত্র রক্তের স্পর্শে আজ আমি গৌরবান্বিত। এর পর থেকে শুধু ছাত্রদের রক্ত নয়, প্রয়োজনবোধে আমাদেরকেও রক্ত দিতে হবে।’ বাংলা বিভাগ আয়োজিত সেই প্রতিবাদ সভায় ড. জোহা আরো ঘোষণা করেন, ‘এরপর আর যদি কোনো গুলি করা হয়, কোনো ছাত্রের গায়ে লাগার আগে সে গুলি আমার বুকে লাগবে।’ ড. জোহা সে কথা রেখেছেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি তার সে ওয়াদা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। 


ড. জোহাকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমি ছিলাম তার সহকারী প্রক্টর। এ কারণে আমি তার খুব কাছাকাছি আসতে পেরেছিলাম। তার সঙ্গে আন্তরিক একটি সম্পর্ক পারিবারিকভাবে গড়ে উঠেছিল। আমরা একে অন্যের বাসায় ঘনঘন যাতায়াত করতাম। নীলুফার জোহার ব্যক্তিত্ব ছিল আকর্ষণীয় ও মধুর। মুখে সবসময় তার হাসি লেগেই থাকত। বাসায় গেলেই আন্তরিকতার স্পর্শ অনুভব করা যেত। তাদের হাসিখুশি দাম্পত্য জীবন নিয়ে আমরা মাঝে মাঝে রসিকতা করতাম। ড. জোহা আমাকে গভীরভাবে স্নেহ করতেন, আমি তাকে অন্তর দিয়ে শ্রদ্ধা করতাম। আমার প্রতি তার অকৃত্রিম স্নেহ ১৮ ফেব্রুয়ারির করুণ ঘটনার অন্যতম কারণ কিনা তা আমার কাছে এখনো এক বড় প্রশ্ন। মাঝেমধ্যে মনে হয় ঘটনাস্থল থেকে আহত আমাদের উদ্ধার করতে না গেলে ড. জোহা হয়তো বেঁচে যেতেন। কিন্তু যার রক্ত দেশে একটি গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দেবে, যার আত্মদান একটি দেশকে স্বাধীন করবে, ঘটনাস্থলে তাকে যেতেই হবে, নিয়তির এ ছিল অমোঘ বিধান।


১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারির যে করুণ স্মৃতি আমাদের বুকের মধ্যে জমাট হয়ে আছে। সে স্মৃতি কখনো ভুলার নয়। সকালে শীত যেমন থাকার কথা, সে বছর শীত তেমন ছিল না। সে কারণে সকালে সোয়েটার গায়ে দেয়ার প্রয়োজন হয়নি। শার্ট গায়ে বিভাগীয় কাজে চলে যাই। সার্জেন্ট জহুরুল হকের নির্মম হত্যার প্রতিবাদে ছাত্রদের একটি বিক্ষোভ মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে শহরের দিকে এগিয়ে যাবে এমন কথা আমাদের কানে এসেছিল। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা এত বেশি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল যে, সেখানে প্রক্টর বা সহকারী প্রক্টর হিসেবে আমাদের নিয়ন্ত্রণ করার কিছু ছিল না। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে বাংলা বিভাগ আয়োজিত পুস্তক প্রদর্শনীর কাজে আমি ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে খুব ব্যস্ত ছিলাম। বর্তমান শহীদুল্লাহ কলা ভবনের ১৫০ নম্বর কক্ষে বাংলা একাডেমির বই সাজিয়ে-গুছিয়ে নেয়া হচ্ছিল, এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, ছাত্রছাত্রীরা প্রাণের ভয়ে এদিক-সেদিক ছুটোছুটি করছে। বেলা তখন আনুমানিক সাড়ে ৯টা। 


ছাত্রছাত্রীদের বিপদের কথা ভেবে সব কাজ ফেলে রেখে এগিয়ে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয় গেটের দিকে। নাটোর রোডে পা দিয়েই বুঝতে পারলাম সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ছাত্রদের গুলি করার জন্য রাইফেল তাক করে বসে আছে। ড. জোহা এবং তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন শিক্ষক, যেমন ড. মযহারুল ইসলাম, ড. এমআর সরকার, অধ্যাপক হবিবুর রহমান (পরবর্তী সময়ে শহীদ) ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. কছিম উদ্দিন মোল্লা, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের নাটোর রোড থেকে সরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ড. জোহা কর্মরত সামরিক অফিসারকে বলছিলেন ‘প্লিজ ডোন্ট ফায়ার, আমার ছেলেরা এখনই চলে যাবে ক্যাম্পাসের মধ্যে।’ কিন্তু সামরিক অফিসারটি কোনো কথা শুনতে রাজি নন। তিনি সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের গুলি করার জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। বিশ্ববিদ্যালয় গেটে সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের উপস্থিতি আমাদের ছাত্রদের উত্তেজিত করে তুলছিল। সামরিক বাহিনীর সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত ছিলেন মো. নাছিম। আমরা তখন ঘটনাস্থলে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট নাছিম সাহেবকে অনুরোধ জানিয়ে বললাম, বিশ্ববিদ্যালয় গেটে সেনাবাহিনীর লোকজনের উপস্থিতি আমাদের ছাত্রদের উত্তেজিত করে তুলছে, জওয়ানদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট থেকে সরিয়ে নিলেই আমরা ছাত্রদের ক্যাম্পাসের ভেতরে সরিয়ে নিতে পারব। আমাদের কথায় ম্যাজিস্ট্রেট নাছিম সাহেব জওয়ানদের রেডিওর গেটের দিকে সরিয়ে নিতে সম্মত হন এবং সেই মোতাবেক নাছিম সাহেব একটা জিপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান গেট ছেড়ে বেশ খানিকটা পূর্বে রেডিওর গেটের দিকে এগিয়ে যান। জওয়ানরাও ধীর পায়ে রেডিওর গেটের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। 

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us