‘যাহা চাই তাহা পাই না, যাহা পাই তাহা চাই না’-বিখ্যাত উক্তি। ‘কোটা’ না ‘মেধা’, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে’র কথা সামনে রেখে এবং তৎপরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দেখে ও শুনে আমার এ কথাই মনে পড়ছে। কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের আবেগের কথা মনে রেখেই এ কথা বলছি। কেন, বুঝিয়ে বলি। মধ্যবিত্তের জীবনে অনেক সেবা দরকার। ধনী ও অতিধনীদের তো বটেই। ফ্রিজ, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, ওভেন, ফ্যান, এসি, পয়ঃব্যবস্থা, বিদ্যুৎ সংযোগ, ড্রাইভার, মেকানিক, কাঠমিস্ত্রি থেকে শুরু করে নানারকমের দৈনন্দিন সেবা দরকার। অথচ বাস্তবে দেখা যায়, এসব সেবা অনেক সময় মেলে না। নির্দিষ্ট একজন মিস্ত্রির জন্য ‘বুকিং’ দিতে হয়। ভালো ড্রাইভার পাওয়া যায় না। এসি মেরামতের জন্য ভালো কারিগর নেই। ভালো প্লাম্বার পাওয়া যায় না। কত বলব? জীবনের ধাপে ধাপে দক্ষ, শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত লোকের/যুবকের অভাব। এমনকি বাসাবাড়িতে আজকাল ‘বুয়া’ পর্যন্ত পাওয়া যায় না। এসবই কিন্তু প্রয়োজনীয় সেবা। বিশাল এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য এ সেবাগুলো ভীষণ দরকার।
শুনতে পাচ্ছি, আজকাল নাকি আমাদের মধ্যবিত্তের হার মোট জনসংখ্যার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ, অর্থাৎ সংখ্যায় ৫-৬ কোটি। কী বিশাল বাজার ভাবা যায়? এদিকে শিল্পমালিক ও ব্যবসায়ীদের অনুযোগ-অভিযোগ-তারা তাদের শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ লোক/যুবক পান না। বিপণন (মার্কেটিং), হিসাবরক্ষণ, নিরীক্ষণ, গুণগতমান নিয়ন্ত্রণ (কোয়ালিটি কন্ট্রোল), ওয়েল্ডিং, ওয়াশিং, ফিনিশিং, ডায়িং, প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন যুবক ইত্যাদি তারা পান না। তারা খোঁজেন, কিন্তু যা পান তা কোনো কাজের নয়। অথচ চারদিকে যুবক-যুবতী, বেকার, অর্ধবেকার, ছদ্মবেশী বেকার, কর্মচ্যুত মধ্যবয়সি লোকজন। তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন চাকরির জন্য। সংসদ-সদস্য, মন্ত্রী, সচিব, প্রভাবশালী লোকজন, বড় ব্যবসায়ীদের পেছনে পেছনে ঘুরছেন চাকরির জন্য। গ্রামে এসএসসি, এইচএসসি, বিএ পাশ সাধারণ যুবকরা ঘুরছেন ম্যানপাওয়ার দালালদের পেছনে। জমি বিক্রি করছেন, টাকা ধার করছেন বিদেশে যাওয়ার জন্য। তারা কাজ করেন না। শত হোক তারা লেখাপড়া শিখেছেন। কায়িক শ্রমের কাজ করেন কী করে? তারা কৃষিতে যেতে চান না-কৃষি অলাভজনক ও ‘অসম্মানের’ কাজ। এসব কারণে যুবক-যুবতী, তরুণরা কিছুটা লেখাপড়া করেই খুঁজছেন চাকরি। গ্রামে গ্রামে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। বিএ, এমএ, বিবিএ, এমবিএ’র ছড়াছড়ি। হাজার হাজার, লাখ লাখ। সবাই চাকরি চান, চাকরিতেই ‘ক্ষমতা’, চাকরিতেই পয়সা, বিশেষ করে সরকারি চাকরিতে। চোখের সামনে তারা দেখছেন সরকারি চাকরি কী জিনিস।
মুশকিল হচ্ছে, দেশে যত বেকার আছে, তত লোকের তো চাকরি নেই, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা সরকারিভাবে নেই। এক তথ্যে দেখা যায়, দেশে মোট কর্মক্ষম শ্রমশক্তি হচ্ছে ৭ কোটি ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। এটা ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান। এর মধ্যে কর্মে নিয়োজিত বলা হচ্ছে ৭ কোটি ৯ লাখ ৮০ হাজার। অতএব, বেকার ২৪ লাখ ৭০ হাজার। প্রতিবছর এ সংখ্যার সঙ্গে নতুন নতুন বেকার যোগ হয়। এত বিপুলসংখ্যক বেকারের চাকরির/কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কী? দৃশ্যতই তিনটি পথ : সরকারি চাকরি, সংগঠিত বেসরকারি খাতে চাকরি, ক্ষুদ্রশিল্প-কুটির শিল্প-মাঝারি শিল্পে নিয়োজিত স্মল এন্টারপ্রাইজে কর্মসংস্থান। বলা দরকার, এ ধরনের এন্টারপ্রাইজের সংখ্যা দেশে ৭০-৮০ লাখ। এরই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে। তারপর করছে সংগঠিত (অর্গানাইজ্ড) বেসরকারি খাত-ব্যাংক, বিমা, লিজিং কোম্পানি, হাসপাতাল, নার্সিং হোম, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, তৈরি পোশাকশিল্প, ওষুধ কোম্পানি, সিমেন্ট ও রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, চিনিকল, বড় বড় ‘বিজনেস গ্রুপ’, বিপণন কোম্পানি, আমদানিকারক ও রপ্তানিকারক ইত্যাদি। এরপর রয়েছে সরকারি চাকরি।
মুশকিল হচ্ছে, সরকারি চাকরির সংখ্যা খুবই কম। যেমন, একটি খবরে দেখলাম ৩৫ থেকে ৩৯তম বিসিএস-পাঁচটি নিয়োগ পরীক্ষায় সর্বমোট ১৪ হাজার ৮১৩ জন চাকরি পেয়েছেন। ৪০তম বিসিএসের ‘জেনারেল ক্যাডারে’ নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ৫৭৪ জন। ৪১তম বিসিএসে ৮১৬ জন এবং ৪৩তম বিসিএসে জেনারেল ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন মাত্র ৬৪৫ জন। এসবই কাগজে প্রকাশিত তথ্য। সত্য-মিথ্যা বলতে পারব না। তবে চোখ বুজে বলা চলে, সরকারি চাকরির সংখ্যা সামান্যই-প্রয়োজনের তুলনায়, চাহিদার তুলনায়।
মুশকিল হচ্ছে এই যে, এতদসত্ত্বেও সরকারি চাকরিতে ঢুকতেই সবাই আগ্রহী। অথচ দুই দশক আগেও বেসরকারি চাকরির প্রতি আগ্রহ ছিল সবার। ১৯৮৪-৮৫ সালের দিকে যখন বেসরকারি ব্যাংক-বিমা-আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালু হয়, তখন সরকারি ব্যাংক ছেড়ে সবাই বেসরকারি খাতে চাকরি করতে এসেছে। বিশাল বেতন-ভাতা। একটু উপরের পদ হলে গাড়ি, জ্বালানি তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ, আপ্যায়ন সবই ফ্রি। লাভই লাভ। ভীষণ আকর্ষণীয় বেসরকারি ব্যাংকের চাকরি। স্বল্প সুদে গৃহঋণ, ফ্ল্যাট ঋণ। অনেকে ওই টাকায় উত্তরায় বাড়ি-ঘর করেছেন। জমির দরখাস্ত যারাই করেছেন, তারাই বরাদ্দ পেয়েছে। কী ভীষণ লোভনীয় চাকরি। শুধু ব্যাংক-বিমা নয়, সংগঠিত অন্যান্য বেসরকারি খাতেও অফুরন্ত সুযোগ-সুবিধা। মালিকরা রীতিমতো সব কর্মচারীর স্বার্থ দেখতেন। মৃত্যুর পরও মালিকরা মৃত কর্মচারীর ছেলেমেয়েদের চাকরি দিতেন। চিকিৎসার খরচ দিতেন। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ায় সহায়তা করতেন। এসব নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। কিন্তু আজ বেসরকারি খাতে চাকরি আমেরিকার চাকরির মতো। অনেক ক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক। ছোট ছোট চাকরি ‘আউটসোর্সিং’ করা অল্প দামে। বেতন-ভাতা অনেক ক্ষেত্রে নিয়মিত নয়। পদোন্নতি অনিশ্চিত। ‘টার্গেটের’ অত্যাচার। যখন-তখন চাকরি যায়। অনেক ক্ষেত্রে চাকরিচ্যুত হলে কোনো সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যায় না। বিশাল পরিবর্তন।
আগে আমাদের বেসরকারি খাত যে ম্যানেজমেন্ট মডেল অনুসরণ করত, তা ছিল প্রাচ্য দেশীয় জাপানের মতো। ‘লাইফ লং এমপ্লয়ম্যান্ট’। আজ আর তা নেই। মালিকদের পরের প্রজন্ম, নতুন প্রজন্ম আমেরিকার ম্যানেজমেন্ট মডেল অনুসরণ করে। ‘মার্কেট ইকোনমি’, আগ্রাসী মার্কেট ইকোনমি আর কী! এখানে গুণ, মেধা, দক্ষতার কথা বলা হয়। চূড়ান্ত বিচারে তা আনুগত্য। এর উদাহরণ বহু। এদিকে সরকারি খাত এখন সুযোগ-সুবিধায় ভর্তি। ‘এলে গেলে বেতন চাই, কাজ করলে ওভারটাইম পাই’। ঢাকায় বসে কিশোরগঞ্জে চাকরি। বেতন বেড়েছে দ্বিগুণ। সুযোগ-সুবিধা বেড়েছে দ্বিগুণ। বাণিজ্যিক অফিস না হলেও এখানে আছে ‘বোনাস’। পদোন্নতি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বছর বছর। সেক্রেটারিতে হয় না-এখন ‘সিনিয়র সেক্রেটারি’। পদ নেই, কিন্তু পদোন্নতি আছে। যতই উপরে, ততই কর্মকর্তার সংখ্যা অনুমোদনপ্রাপ্ত পদের চেয়ে বেশি। একটু বড় অফিসাররা গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে ৫০ হাজার টাকা পান। পেনশন সুবিধা অবসরের পর-ছেলেমেয়েদের জন্যও। ৫ কাঠা জমি সিনিয়রদের বেলায় নিশ্চিত। অবসরের সময় এক কাঁড়ি টাকা-লাখ, কোটি টাকা। অসম্ভব ব্যাপার-আগের তুলনায়। এসবই করা হয়েছে দুর্নীতি বন্ধের জন্য। প্রধানমন্ত্রী বেতন বৃদ্ধির পর বলেছিলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে। কিন্তু আমরা পেয়েছি বেনজীর আহমেদ, মতিউর রহমানের মতো শত শত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। অভাবনীয় ব্যাপার। চিন্তার বিষয়। গভীরভাবে ভাবার বিষয়।
মেধাবীরা কী করছে? মেধা ও মধু কি এক হয়ে গেছে? তা না হলে কেন সামান্য কয়েকটা চাকরির জন্য লাখ লাখ কোমলমতি ছাত্রছাত্রী রাস্তায় নেমে পড়ল। বলল কী? বলল ‘মেধার’ কথা। মেধার ব্যাপারে কারও কোনো প্রশ্ন থাকতে পারে না। কবিতা, সাহিত্য, গল্প লেখা, বিজ্ঞানচর্চা, শিল্পকর্ম-এগুলো হলো প্রকৃত মেধার স্থান। যেমন জয়নুল আবেদিন ছিলেন মেধাবী শিল্পী। এসব ক্ষেত্রে মেধার কোনো পরীক্ষা দিতে হয় না। এর বিপরীতে আমরা যাকে ‘মেধা’ বলছি, তা কি মেধা, প্রকৃতই মেধা? প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হচ্ছে ‘প্রসেস অফ ইলিমিনিনেশন’। ৫০০ লোক নেওয়া হবে। ১০ হাজার প্রার্থী। এর থেকে বাছাই। প্রথমে ‘এমসিকিউ’, পরে রচনামূলক পরীক্ষা, তারপর মৌখিক-যাতে প্রচুর নম্বর। এসবে উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য কী প্রতিযোগিতা, কী তদবির! ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো নোটবই খোঁজে, নীলক্ষেত ভর্তি এসবে। কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। প্রশ্নপত্র খোঁজে। প্রয়োজনে টাকা দিয়েও প্রশ্নপত্র জোগাড় করে। চাকরির জন্য রীতিমতো ঘুস বাণিজ্য হয়। এসব কথা আর গোপন কিছু নয়। মুখে মুখে একই কথা।