স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন যেদিন (২৭ জুন) জানালেন যে, দেশের সব হাসপাতালে চন্দ্রবোড়া বা রাসেলস ভাইপার সাপের বিষের প্রতিষেধক আছে— তার ঠিক দুদিন পরেই (২৯ জুন) ঝালকাঠিতে সাপের বিষের প্রতিষেধক বা অ্যান্টিভেনম না পেয়ে সেলিম আকন নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।
২৭ জুন বিএসএমএমইউতে সাম্প্রতিক সাপ আতঙ্ক নিয়ে এক সেমিনারে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, চন্দ্রবোড়া সাপে কামড়ের ওষুধ দেশের সব হাসপাতালে আছে। তাই কাউকে দংশন করলে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে।
এর দুদিন পরেই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম: সাপের কামড়ে ব্যবসায়ীর মৃত্যু, অ্যান্টিভেনম না দেওয়ার অভিযোগ। খবরে বলা হয়, ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলায় সাপের কামড়ে মো. সেলিম আকন (৬০) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে। শনিবার (২৯ জুন) সকালে উপজেলার তালতলা বাজারের দোকানে তাকে সাপ কামড় দেয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেন। কিন্তু অ্যান্টিভেনম (প্রতিষেধক) থাকা সত্ত্বেও তা না দেওয়ার অভিযোগ করেছেন স্বজনরা। তারা বলছেন, চিকিৎসকরা তাদের জানিছেন, তাদের কাছে অ্যান্টিভেনম রাখার স্টোররুমের চাবি নেই, তাই চিকিৎসা দিতে পারছেন না। ঘণ্টাখানেক পর রোগীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পথে সেলিমের মৃত্যু হয়।
এর আগে এই একই এলাকায়, অর্থাৎ ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলায় হ্যাপি আক্তার নামে আমার এক আত্মীয় সাপের দংশনে মারা যান। তাকেও প্রথমে আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়েছিল। তাকেও বলা হয়েছিল যে অ্যান্টিভেনমন নেই। পরে নেয়া হয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে। সেখানেও চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হয়ে স্বজনরা তাকে নিয়ে বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেলে রওয়ানা হলে পথেই হ্যাপি আক্তারের মৃত্যু হয়। দুটি ছোট সন্তান রেখে তিনি মারা যান। তার স্বজনরাও বলছেন, তারা পরে শুনেছেন যে আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনমন ছিল। কিন্তু কোনো কারণে সেই চিকিৎসা ওখানে পাওয়া যায়নি।
আমুয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কাঁঠালিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা তাপস কুমার পালের সঙ্গে আমি নিজেও কথা বলার চেষ্টা করেছি। ৩০ জুন দুবার ফোন দিয়ে পাইনি।
সবশেষ ব্যবসায়ী সেলিম আকনের মৃত্যুর ঘটনাটি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করলে ঘটনার দিনই তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা ডা. শিউলী পারভীনকে সভাপতি করে গঠিত এই কমিটির সদস্য সচিব ঝালকাঠি সিভিল সার্জন অফিসের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং সদস্য হিসেবে আছেন মেডিলে অফিসার ডা. মো. সিয়াম আহসান।
বাংলাদেশে সাপেকাটা রোগীর মৃত্যুর কারণ প্রধানত তিনটি।
১. সাপে দংশন করার পরে হাসপাতালে না নিয়ে ওঝার কাছে নেয়া বা নিজেরাই চিকিৎসা করা। যদিও এই প্রবণতা কমেছে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে।
২. হাসপাতালে অ্যান্টিভেনম না থাকা। অর্থাৎ কাউকে সাপে দংশন করলে সঙ্গে সঙ্গে তার ক্ষত স্থানের উপরে শক্ত করে বেঁধে নিয়ম অনুযায়ী রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো, কিন্তু অ্যান্টিভেনম দেয়া গেল না।
৩. রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেয়া হলো, সেখানে অ্যান্টিভেনমও ছিল—কিন্তু নানাবিধ জটিলতায় অ্যান্টিভেনম দিতে দেরি হলো কিংবা দেয়া গেল না। এরকম পরিস্থিতিতে মৃত্যু হলে সেটিকে নিছক দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু বলার সুযোগ নেই। এটি অপরাধ। কেননা হাসপাতালে অ্যান্টিভেনমের মজুদ না থাকা কিংবা রোগীকে সময়মতো হাসপাতালে নিতে না পারায় মৃত্যু আর চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকার পরেও সেটি নিশ্চিত করতে না পারায় মৃত্যু এক কথা নয়।