অর্থনৈতিকভাবে উন্নত অস্ট্রেলিয়ায় শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রতিবছর কয়েক লাখ লোক গমন করেন। পৃথিবীর অন্যতম অভিবাসনবান্ধব দেশ অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় এক লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন। শ্রমশক্তির ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে দেশটি প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক দক্ষ জনশক্তিকে অভিবাসী হিসাবে গ্রহণ করে। দক্ষ অভিবাসী জনশক্তি অস্ট্রেলিয়া ও সে দেশের পার্শ্ববর্তী দেশ নিউজিল্যান্ডের অর্থনীতিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। প্রায় ৫০ লাখ অধিবাসীর দেশ নিউজিল্যান্ডেও প্রায় ৮ হাজার বাংলাদেশি বসবাস করেন। তবে উন্নত দেশ দুটিতে অদক্ষ বৈদেশিক শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ নেই।
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডসহ উন্নত দেশের শ্রমবাজার সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় এসব দেশে কর্মসংস্থানে আগ্রহী ব্যক্তিরা এ সুযোগ গ্রহণ করতে পারেন না। তারা অনেক সময় প্রতারণার শিকার হন। কিছু বাংলাদেশি উন্নত জীবনের আশায় শেষ সম্বল জমি বা অন্যান্য সম্পত্তি বিক্রি করে অবৈধভাবে নৌকাযোগে বিপদসংকুল পথে অথবা অন্যভাবে অস্ট্রেলিয়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে থাকেন। এছাড়া কেউ কেউ ভিজিট ভিসায় গিয়ে সে দেশে অবস্থানের চেষ্টা করেন। এ ভিসায় সে দেশে যাওয়ার পর অতিরিক্ত সময় অবস্থান, বৈধভাবে স্থায়ী অভিবাসী হওয়া এবং লেখাপড়া বা কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। এসব ক্ষেত্রে অধিকাংশ ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট দেশের বর্ডার ফোর্স বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে আটক হয়ে ডিটেনশন সেন্টারে বছরের পর বছর আটক থাকেন অথবা সংশ্লিষ্ট দেশ সরাসরি বা আন্তর্জাতিক সংস্থা আইওএমের মাধ্যমে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়। এ ধরনের অবৈধ প্রবেশ বা অবস্থানের প্রচেষ্টার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও তাদের পরিবার দালালদের হাতে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যায় এবং কতিপয় অসাধু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। প্রতারণা রোধে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের একটি সতর্কবার্তায় এসব দেশে চাকরি পেতে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাজের ভিসাসংক্রান্ত কাগজপত্র প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ হাইকমিশনের মাধ্যমে যাচাই করার অনুরোধ করা হয়। একইসঙ্গে ভিসাসংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সম্পর্কে অবগত থাকার জন্যও অনুরোধ করা হয়। এছাড়া, অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশে প্রবেশের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করে। এতে দেশের শ্রমবাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ে এবং সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
তবে বাংলাদেশের কর্মীদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারলে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডসহ উন্নত দেশে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশির কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ দুটি দেশে স্বাস্থ্যসেবা, কৃষি, নির্মাণ, আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও হসপিটালিটি এবং বিভিন্ন ধরনের ট্রেডসহ প্রায় শতাধিক সেক্টরে কাজের সুযোগ রয়েছে। যদিও কৃষি ও অন্যান্য খাতে অস্থায়ী শ্রমিকের চাহিদা মেটানোর জন্য অস্ট্রেলিয়া কেবল তার পার্শ্ববর্তী প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে চুক্তি করেছে এবং প্রতি বছর কয়েক হাজার শ্রমিক এসব দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় কাজের জন্য গমন করেন। এ সুযোগ অন্য কোনো দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এছাড়া ওয়ার্ক অ্যান্ড হলিডে ভিসার আওতায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোক অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবার ৯ মাসের জন্য যায় এবং কাজ করার সুযোগ পায়। ইতঃপূর্বে কিছু বাংলাদেশি এ সুযোগের অপব্যবহার করায় বর্তমানে বাংলাদেশ এ ভিসার আওতাভুক্ত নয়।
অস্ট্রেলিয়া কর্মী সংকট নিরসনে ২০২৩ সাল থেকে প্রতিবছর ১ লাখ ৯৫ হাজার বিদেশিকে স্কিলড ভিসা প্রদানের ঘোষণা দেয়। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয়। অস্ট্রেলিয়ায় কর্মসংস্থানের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসাবে সংশ্লিষ্ট পেশা সম্পর্কিত বিষয়ে অনার্স বা মাস্টার্স ডিগ্রি আবশ্যক। টেকনিশিয়ান পদে ন্যূনতম যোগ্যতা ৪ বছরের ডিপ্লোমা বা সার্টিফিকেট থ্রি/ফোর। ইংরেজি ভাষার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য আইএলটিএসে স্কোর ৫.৫ থেকে ৬ থাকতে হবে। সংশ্লিষ্ট পেশায় ৪ থেকে ৫ বছরের পূর্ণকালীন চাকরির অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। অভিজ্ঞতা প্রমাণের জন্য নিয়োগপত্র, নিয়োগকারীর কাছ থেকে রেফারেন্স লেটার, বেতন স্লিপসহ অন্যান্য কাগজপত্র প্রয়োজন হয়। অস্ট্রেলিয়ার নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কাজের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত সনদের অ্যাসেসমেন্ট করাতে হয়, যা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। ফলে অনেকে অ্যাসেসমেন্ট করাতে রাজি হয় না। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের বৈধ স্পন্সরশিপ বা বৈধ নিয়োগকর্তা প্রয়োজন হয়। অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণে সে দেশের শ্রমবাজার সম্পর্কে কর্মীদের মধ্যে সঠিক ধারণা প্রয়োজন। দেশের অধিকসংখ্যক যোগ্য রিক্রুটিং এজেন্সি অস্ট্রেলিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে কাজ করলে সে দেশে বংলাদেশের জন্য শ্রমবাজার সম্প্রসারিত হতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের উদ্যোগে ২০২২ সালে সে দেশের ৫টি বেসরকারি রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।