গত ৬ জুন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’ শীর্ষক জাতীয় বাজেট পেশ করেছেন। বাজেট বক্তৃতায় তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সর্বশেষ নির্বাচনী ইশতেহারের ১১টি বিশেষ অগ্রাধিকার উল্লেখ করে বলেছেন, সেগুলো হবে এবারের বাজেটের সম্পদ সঞ্চালনার প্রধান ভিত্তি। ইশতেহারের অন্যতম অঙ্গীকার ছিল– ‘দ্রব্যমূল্য সকলের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।’ প্রশ্ন হচ্ছে, প্রস্তাবিত বাজেটে দ্রব্যমূল্য সবার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে বা মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রায় আনতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
আমরা জানি, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর টানা চার মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক সূচকে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়ে আসছিল। এর ফলে ১৪ বছরের মধ্যে ৪০ শতাংশের বেশি দারিদ্র্যের হার ১৮ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। অতি দারিদ্র্যের হার এখন মাত্র ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। করোনা অতিমারির আগে বছর বছর বাড়ছিল প্রবৃদ্ধির হারও। করোনার ঠিক আগের বছর দেশজ আয়ের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ।
করোনার অভিঘাতে ইউরোপের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং মার্কিন অর্থনীতি ঋণাত্মক ২ দশমিক ৮ শতাংশ হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছিল ধনাত্মক ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। তবে পরের বছরই প্রবৃদ্ধি স্বাভাবিক হয়ে যায়। ২০২০-২১ থেকে পরবর্তী তিন অর্থবছরে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। আর ২০২৩-২৪ সালের প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত বাজেটে ২০২৪-২৫ সালের জন্য জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম, সুদের হার, পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং টাকার মান হ্রাস– এই চতুর্মুখী চাপ আমাদের অর্থনীতিতে সৃষ্টি করে ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতি। এসব সত্ত্বেও অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে, যা বাংলাদেশের অর্থনীতির সহনশীলতা ও টেকসই অবস্থা প্রমাণ করে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহ শৃঙ্খলে ত্রুটি, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া আমাদের বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণ। একই সময়ে দেশে গড় মজুরি বেড়েছে ৭ শতাংশের বেশি হারে। মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির হারের মধ্যে ২ শতাংশের একটা ফারাক রয়েছে। ২ শতাংশের অভিঘাত লাঘব করার জন্য এই বাজেট নিম্ন আয়ের ৫০ লাখ পরিবারকে খাদ্য সহায়তা এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সারাদেশে নিম্ন আয়ের প্রায় এক কোটি পরিবারকে টিসিবি ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রতি মাসে দুই লিটার সয়াবিন তেল, দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি এবং খাদ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩০ টাকা দরে পাঁচ কেজি চাল বিক্রি অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। বাজেটের এই বরাদ্দের ফলে ৬ থেকে ৭ কোটি মানুষের কমে যাওয়া ক্রয়ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ রাখা হয়েছে।
বস্তুত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পথ দুটি: ১. বাজারে অর্থ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মোট চাহিদা কমিয়ে আনা এবং ২. পণ্য ও সেবার সরবরাহ বাড়িয়ে পণ্যমূল্য কমিয়ে ফেলা। এবারের বাজেট এই দুই পথের মিলন ঘটিয়েছে। দ্রব্যমূল্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে, যার মাধ্যমে সুদের হার বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। এটি মোট চাহিদা কমিয়ে আনতে ভূমিকা রাখছে এবং নতুন পদ্ধতিতে পুনর্নির্ধারণ করা হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার, যা ডলারের বিনিময় হার স্থিতিশীল করেছে। নতুন করে ডলার সংকট হওয়ার আশঙ্কা আর দেখা যাচ্ছে না। রিজার্ভ এখন থেকে বাড়তে শুরু করবে বলে ধারণা করা যায়।