এবার বাজেটে রিজার্ভ স্থিতিকরণের একটি বাস্তবধর্মী প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, আমাদের রিজার্ভ একসময় ৪৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল, মতান্তরে সেই রিজার্ভ এখন দাঁড়িয়েছে ২০ বিলিয়ন ডলারে। আপাতত এই রিজার্ভে কোনো অসুবিধা না হলেও সবার মনেই উৎকণ্ঠা ও শঙ্কা আছে।
এই উৎকণ্ঠা বাড়িয়ে দিয়েছে বিভিন্ন মুখরোচক কথা। ব্যাংকে এলসি খুলতে গেলে আসলেই সহজে এখন আর সেটা সম্ভব হচ্ছে না।বিদেশে চিকিৎসা ও শিক্ষার জন্য দুই বছর আগেও যেভাবে সহজে বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয় করা বা বহন করা যেত, এখন তা অনেকটাই দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। এই সংকট ধীরে ধীরে ঘনীভূত হচ্ছে, সামনে আরও তীব্রতর হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। গত এক বছরের প্রাক্কলন দেখলে এই ভীতি যে অমূলক নয়, তার বাস্তব চিত্র বোঝা যাবে। রিজার্ভ স্থিত করতে যে কয়টি কাজ করা উচিত, সেগুলো বিশ্লেষণ করছি।
ক. দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ব্যক্তি যাঁরা বিদেশে কর্মরত আছেন, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যসহ মালয়েশিয়া, ইতালি, সিঙ্গাপুর, গ্রেট ব্রিটেনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, তাঁরা প্রতি মাসেই দেশে টাকা পাঠান। এই টাকার উৎস সম্পর্কে একটি ধারণা নিতে হবে। প্রতিটি গ্রাম, ইউনিয়ন ও থানা পর্যায়ে কতজন লোক বিদেশ থেকে প্রতি মাসে টাকা পাঠান, এই টাকা যদি ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশি মুদ্রায় আসে, তাঁদের একধরনের তালিকা তৈরি করতে হবে। যদি সেই টাকা স্থানীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি বা কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট থেকে আসে, তাহলে বুঝতে হবে সেটি হুন্ডি হচ্ছে। তাদেরও একটি তালিকা তৈরি করতে হবে। পরে যাঁরা হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাঁদের সতর্ক করতে হবে অথবা বোঝাতে হবে যে ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠানো লাভজনক, নিজের জন্য ও দেশের জন্য।
এখানে একটি কথা বলতেই হবে। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো রকম আতঙ্ক সৃষ্টি করা যাবে না। তাহলে স্থানীয় ‘টাউট’ শ্রেণির মানুষ ও স্থানীয় কিছু সরকারি কর্মচারী এই উদ্যোগের অপব্যবহার করে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করবে। আর একটা দিক লক্ষ রাখতে হবে, প্রতিবছর টাকার অবমূল্যায়ন করে ডলারের দাম বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। সরকার যদি ৫ টাকা বাড়ায়, হুন্ডি ব্যবসায়ীরা ৬ টাকা বাড়িয়ে দেবে, এটা চলতেই থাকবে সরকারি রেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এখানে জনসচেতনতা ও স্থানীয় প্রশাসনের মোটিভেশনাল যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করতে হবে।
খ. আমদানি-রপ্তানির ক্ষেত্রে অবমূল্যায়ন ও অতিমূল্যায়ন রোধ করতেই হবে। আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রেই অবমূল্যায়ন হয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র দুভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যে অঙ্কের টাকা অবমূল্যায়ন হয়, সেই টাকার বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে ক্রয় করা হয়। হুন্ডির মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা হলে সরকার বৈদেশিক মুদ্রা এবং রাজস্ব হারায়। রপ্তানি পণ্যের ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়ন হয়। এ ক্ষেত্রে অতিমূল্য দেখিয়ে রপ্তানি করে, সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়; বিশেষ করে ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চমূল্য দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়।
যেসব পণ্যের শুল্ক হার শূন্য অথবা শূন্যের কাছাকাছি, ১ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে, এসব পণ্যের ক্ষেত্রেও উচ্চমূল্য দেখিয়ে পণ্য আমদানি করা হয়। বন্ডের মাধ্যমে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে উচ্চমূল্য দেখানো হয়। এখানে রাষ্ট্রের তিন ধরনের ক্ষতি হয়। প্রথমত, বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হয়। দ্বিতীয়ত, সরকার রাজস্ব হারায়। তৃতীয়ত, স্থানীয় শিল্প রুগ্ণ হতে থাকে। উল্লিখিত ক্ষেত্রে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ ভূমিকা নিতে পারে। শুধু দরকার সদিচ্ছা ও সঠিক মনিটরিং।
২. দ্বিতীয় যে কাজটি করতে হবে তা হলো, ব্যাংকের তারল্যসংকট দূর করা। বর্তমানে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হওয়ার দরুন কালোটাকা ব্যাংকে রাখা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। সাধারণত ঘুষের টাকা, দুর্নীতির টাকা, ট্যাক্স ফাঁকির টাকা, চাঁদাবাজির টাকা, অর্থাৎ অবৈধ কালোটাকা এখন আর কেউ ব্যাংকে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। কালোটাকারমালিকেরা টাকা রাখে সিন্দুকে। অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের সিন্দুক-তত্ত্ব এখানে প্রযোজ্য। সিন্দুক-তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে এই টাকা কোথায় রাখে, কীভাবে রাখে, সেটা বোঝা যাবে।