১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে প্রকাশিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জনসংযোগ বিভাগের একটি প্রকাশনা ‘সাধারণ পরিচিতি ও ঘোষণা পুস্তিকা ১৯৭৩-৭৪’ থেকে জানা যায়, ১৯৭০ সালের নভেম্বর মাসে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্বোধন ঘোষণা করা হয় ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি। স্বনামধন্য স্থপতি মাজহারুল ইসলাম গত শতাব্দীর ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রায় ৭৫৩ একর জমির ওপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছিলেন। ঢাকা শহর থেকে দূরে বিধায় আবাসনসুবিধাসহ সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা এ পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
সে সময় মোট তিন হাজার শিক্ষার্থীর জন্য যে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়, তা ১৯৮০ সালের মধ্যেই পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করা হয়েছিল। সে সময় সামগ্রিক এ মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করে খুব অল্পসংখ্যক ভবনই তৈরি করা হয়। যার মধ্যে শিক্ষা ও প্রশাসনিক কাজের জন্য একটি ভবন, দুটি ছাত্রাবাস এবং বিশমাইলের কাছে কিছু স্টাফ কোয়ার্টার উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে আর মাস্টারপ্ল্যান অনুসরণ করে বাস্তবায়ন করা যায়নি। সময়ের সঙ্গে বিভাগ ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু অনিবার্যভাবে প্রয়োজন থাকলেও নতুন চাহিদার নিরিখে মাস্টারপ্ল্যানটি আর হালনাগাদ করা হয়নি।
প্রথম মাস্টারপ্ল্যানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য
স্থপতি মাজহারুল ইসলাম এই অঞ্চলের ‘সান-পাথ ডায়াগ্রাম’ বিবেচনায় নিয়ে প্রাকৃতিক আলো ও বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে আড়াআড়ি উত্তর-দক্ষিণে সমান্তরাল জ্যামিতিক রেখার ভেতর বর্গক্ষেত্র ও ত্রিভুজে বারবার বিভাজন করে রোড নেটওয়ার্ক ও ভবনগুলো বসিয়ে মাস্টারপ্ল্যানটি প্রণয়ন করেন। মাস্টারপ্ল্যানে জোনিংয়ের ক্ষেত্রে মাঝখানের একটি বড় অংশে শিক্ষা গবেষণা জোন রাখা হয়। এক পাশে শিক্ষার্থীদের আবাসন এবং আরেক পাশে শিক্ষক ও স্টাফদের আবাসন জোন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শিক্ষক ও স্টাফদের আবাসিক ভবনের নকশার ক্ষেত্রে একধরনের ‘দৃশ্য-অবিচ্ছেদ্যতা’ বা ভিজ্যুয়াল কনটিনিউটি বজায় রাখা হয়েছে। স্থপতি সাইফুল হক বলেন, এ ধরনের নকশার মধ্য দিয়ে মাজহারুল ইসলাম ‘সামাজিক সমতার দর্শনকে প্রকাশ করেছেন’।
ক্যাম্পাসের বর্তমান অবস্থা
নতুন নতুন একাডেমিক ভবন ও আবাসিক হল তৈরি করা হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের স্থায়ী ও অস্থায়ী স্থাপনাও তৈরি হয়েছে। এসব স্থাপনা নির্মাণের ক্ষেত্রেও মাস্টারপ্ল্যান যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি মাস্টারপ্ল্যানে কী আছে, সেটাও অনেক সময় খুলে দেখা হয়নি। ফলে মাস্টারপ্ল্যানের বৃহত্তর উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়েছে। উপযুক্ত সমীক্ষা ও তার আলোকে পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া যেখানে-সেখানে ভবন নির্মাণ করা হলে দৃষ্টিনন্দন এই বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক অপচয় ও পরিবেশগত স্থায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হবে।
এখনো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, লেকে পরিযায়ী পাখি, জলাশয়ের গোলাপি শাপলা, বেগুনি রঙের পদ্মফুলের পুকুর, নানা দেশীয় গাছ ও বিভিন্ন রঙের ফুল মানুষকে মুগ্ধ করে। এখানকার উঁচু-নিচু ভূমিরূপ, বৈচিত্র্যপূর্ণ গাছগাছালি, নানা রঙের ফুল-পাখি এই ক্যাম্পাসকে সৌন্দর্যের এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে সবার কাছে। দেশে শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে অনেক গর্ব করার মতো অবদান রেখে চলেছে এই ক্যাম্পাস। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সমীক্ষার মাধ্যমে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক পূর্ণাঙ্গ মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া এই ক্যাম্পাসের টেকসই ভিত্তি দেওয়া সম্ভব নয়।
সীমাবদ্ধ ভূমি ও বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশে প্রতি ইঞ্চি জমি মূল্যবান এবং তার পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। একটি নির্দিষ্টসংখ্যক মানুষের চাহিদার বিপরীতে কোনো একটি এলাকার সম্ভাবনা ও সীমাবদ্ধতাকে বিভিন্ন সমীক্ষার মাধ্যমে বিচার-বিশ্লেষণ করে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করাকে মাস্টারপ্ল্যান বা মহাপরিকল্পনা বলে। এ ধরনের মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের সময় মানুষ ও তার চাহিদাকে কেন্দ্রে রেখে সেই এলাকার জলবায়ু, ভূমিরূপ, মাটির গঠন, পরিবেশ, প্রাণপ্রকৃতি, জলাভূমি, ড্রেনেজ, পয়োনিষ্কাশন, নাগরিক সুবিধা ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।