বাজেট কখনো মূল্যস্ফীতি কমায় না

বণিক বার্তা বিরূপাক্ষ পাল প্রকাশিত: ০৯ জুন ২০২৪, ০৯:২৮

আমাদের অর্থমন্ত্রীরা যতই বলুন যে বাজেটে তাদের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি কমানো, এগুলো শুধুই বাগাড়ম্বরতা। কিংবা রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার উদ্দেশ্য হাসিলকারী কথাবার্তা। বাজেটের লক্ষ্য মূল্যস্ফীতি কমানো নয়। সেটি বাংলাদেশের মতো দুর্বলতম রাজস্ব আয়ের রাজত্বে আরো অসম্ভব যেখানে প্রত্যক্ষ কর বাড়িয়ে শীর্ষ ধনিক গোষ্ঠীকে অসন্তুষ্ট করার কোনো প্রবৃত্তি সরকারের নেই। কর যদি কিছু বাড়াতে হয় তাহলে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর কোথায় কোন কর বা শুল্ক চাপিয়ে দেয়া যায় সেটি খুঁজে বের করাই নীতিনির্ধারকদের উদ্ভাবনী ক্ষমতার উত্তম পরিচয়। সুতরাং বাজেট মূল্যস্ফীতি কমায় না বরং বাড়ায়। কারণ ধনিক গোষ্ঠীর অনুপার্জিত অর্থ অর্থনীতিতে তারল্য বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতিকে চড়িয়ে দেয় কিংবা মচমচে করে রাখে। 


বাজেট যে মূল্যস্ফীতি কমায় না, তার জন্য গত ৫০ বছরের ইতিহাস খুঁজতে হবে না। মাত্র দুই বছর আগে যখন মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১২ শতাংশ, তখন ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য দিলেন ৫ দশমিক ৬ ভাগ। কোত্থেকে যে তিনি এ অদ্ভুত সংখ্যা পেলেন তার উত্তর কেউ জানতে চাইলেন না। ছিল না কোনো গবেষণা। ছিল না কোনো অর্থনৈতিক প্রক্ষেপণ। ফলে যা হওয়ার তা-ই হলো। গত দুই বছরেও এর ধারে-কাছে আসা গেল না। অজুহাত হিসেবে এল এবং এখনো আসছে সেই হরপ্পা যুগের কভিড-উত্তর জোগান সংকট এবং পুতিন কর্তৃক আকস্মিকভাবে ইউক্রেন আক্রমণ। শেষের কারণটিকে ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ পুতিনের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ আমাদের দেশে ‘ইউক্রেন যুদ্ধ’ বলে গেলানো হচ্ছে। 


এ কারণগুলোর সঙ্গে দুএকজন উপদেষ্টা বা মন্ত্রীস্থানীয় কর্তা সময় সুযোগ পেলেই আরেকটি বায়বীয় তত্ত্ব যুক্ত করেন, তার নাম মার্কিন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। কেউ এর গভীরে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সমূহ উন্নতিতে পশ্চিমা দুনিয়ার হিংসা। পড়েছিলাম ছোটবেলায়, হিংসার কারণ কংসের মরণ। কিন্তু পশ্চিমা কংসদের তো মরণ হচ্ছে না। ওরা বরং কমিয়ে ফেলেছে মূল্যস্ফীতি। যুক্তরাষ্ট্রে এখন বেকারত্ব ৩ দশমিক ৯ শতাংশ যা ৪০ বছরের মধ্যে কম। মূল্যস্ফীতিও গত দুবছরে প্রায় ১০ শতাংশ থেকে নেমে এখন সাড়ে তিন শতাংশে। 


পশ্চিমারা অর্থনীতির পাঠ্যবই অনুসরণ করেই এ সুফলগুলো আনতে পেরেছে যা বাংলাদেশে হয়নি। কারণ একটি বিশেষ ধনিক গোষ্ঠীকে সুবিধা দেয়ার জন্য সুদহারে টুপি পরিয়ে রাখা হয়েছে। অন্যদিকে কয়েকজন ডাকসাইটে আমদানিকারককে সুবিধা দেয়ার জন্য টাকার বিপরীতে ডলারের দাম জোরপূর্বক কমিয়ে রেখে রফতানি ও রেমিট্যান্সের সমূহ ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। বিপজ্জনকভাবে কমে গেছে রিজার্ভ এবং এখনো বিপদ কাটেনি। রিজার্ভের রক্তক্ষরণ কমাতে আমদানির কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতির টুঁটি টিপে ধরে তা প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হয়েছে। এটি অদূরদর্শিতার জন্য জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। দ্রব্যের কম জোগান মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। 


মূল্যস্ফীতির প্রশ্নে বাজেট স্ববিরোধী। একদিকে পৌনে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লোভ আর অন্যদিকে প্রায় ১০ শতাংশের মূল্যস্ফীতিকে মাত্র সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার স্বপ্ন একই সঙ্গে জলে ও ডাঙায় বিচরণ করার এক উদ্ভট স্বপ্নজাল মাত্র। এ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি যদি বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৫ দশমিক ৬ ভাগ হয় তাহলে একে প্রায় ৭ শতাংশে টেনে তোলার বিষয়টি অর্থনীতির ফিলিপস সমীকরণ অনুযায়ী স্ববিরোধী। প্রবৃদ্ধি নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা এখন থাকা উচিত ছিল না। শরীরে উচ্চ রক্তচাপসম্পন্ন মানুষকে ম্যারাথন দৌড়েও ফার্স্ট হতে হবে এমন প্রত্যাশা কেউ করে না। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদদেরও ঐকমত্য ছিল যা বাজেটে গ্রহণ করা হয়নি। কিন্তু বিপদের বিষয় হচ্ছে যা এ সামান্য মান-অভিমানেই এর নিষ্পত্তি হয় না। প্রবৃদ্ধির হার উঁচুতে ধরলে বাজেটের অন্য সংখ্যাগুলোকে সেভাবে খাপ খাইয়ে নিতে হয়। বাজেটারি ফ্রেমওয়ার্কের স্প্রেডশিটে তখন সবকিছুই বাড়ে। যেহেতু সরকারের রাজস্ব সক্ষমতা বিশ্বের মধ্যে অন্যতমভাবে দুর্বল, অর্থাৎ সরকার ধনীদের প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে ইচ্ছুক নয় বা কিছু ক্ষেত্রে আজ অপারগ, সেহেতু সব চাপ গিয়ে পড়ে বাজেট ঘাটতি ও বাড়তি ঋণ নেয়ার ওপর। এবারো তাই হয়েছে। বাজেট ঘাটতি বেড়েছে ৮ দশমিক ৩ শতাংশ যা মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়বে প্রায় ৩ শতাংশ এবং বৈদেশিক ঋণ বাড়বে প্রায় ২০ শতাংশ। এর পরও মূল্যস্ফীতি কমে সাড়ে ৬ শতাংশে ঠেকবে সে প্রত্যাশা অর্থনৈতিকভাবে স্ববিরোধী।


বাংলাদেশের বাজেট যেন সিনেমার নায়ক। তাকে নিয়ে অনেক হইচই। কিন্তু ভালো অভিনয় না করার জন্য তিনি কোনো পুরস্কার পান না। সেই নায়ককে এবার প্রথমবারের মতো ফুল শার্টের বদলে হাফ শার্ট পরানো হয়েছে। কিন্তু এতে নায়কের দেহের কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। প্রণেতারা দাবি করেছেন যে, বরাবর যেখানে বাজেটের বৃদ্ধি থাকে ১২-১৩ শতাংশ, এবার তা মাত্র সাড়ে ৪ শতাংশ। কিন্তু ঘাটতি তো বেড়ে গেল ৮ শতাংশের ওপর। বাজেট ঘাটতি সর্বদাই মূল্যস্ফীতিবর্ধক। চলতি বাজেট কমেনি। কিন্তু উন্নয়ন বাজেটে কিছু কাটছাঁট করা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির উসকানিদাতা উপাদান যেমন অপচয়, চুরি, অদক্ষতাজনিত বাড়তি খরচ সবকিছু আগের মতোই থাকবে। শুদ্ধাচার পুরস্কার দিয়েও যদি সরকারি অর্থের অপচয় ও দুর্নীতি না কমানো যায় তাহলে বাজেট কী করে জিনিসপত্রের দাম কমাবে? 

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন
ঘটনা প্রবাহ

ট্রেন্ডিং

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us