অনেক দিন আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতা পড়েছিলাম, কবিতাটির নাম ছিল ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’। এখনো তার কিছু লাইন মনে আছে: ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ/ এই কী মানুষজন্ম? নাকি শেষ/ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা! প্রতি সন্ধ্যেবেলা/ আমার বুকের মধ্যে হাওয়া ঘুরে ওঠে, হৃদয়কে অবহেলা/ করে রক্ত; আমি মানুষের পায়ের কাছে কুকুর হয়ে বসে/ থাকি-তার ভেতরের কুকুরটাকে দেখবো বলে।...’
কবিতাটি পড়ে মনে প্রশ্ন জাগে, আসলেই আমরা কীভাবে বেঁচে আছি? উদ্ভিদগুলো যদি মানুষদের মতো একবেলা ধর্মঘট করে বলে বসে, ‘যাও মানুষ। তোমাদের কুঠারের আঘাত, রোগের সংক্রমণ, কীটের দংশন, বায়ুর দূষণ আমাদের জর্জরিত করে ফেলেছে, আমরা অসুস্থ। আর আমরা তোমাদের অক্সিজেন দিতে পারব না। তোমরাই আমাদের অসুস্থ করে ফেলেছ, তাই এর প্রতিবাদে আমরা সবাই পত্ররন্ধ্রগুলো পাঁচ মিনিটের জন্য বন্ধ করে রেখে দেব। ওই সময়টুকুতে আর আমরা তোমাদের কোনো অক্সিজেন দেব না।’ যদি সত্যিই পৃথিবীর গাছপালাগুলো সবাই একসঙ্গে এ রকম কাণ্ড কোনো দিন করে বসে? এ রকমটা হলে সেই পাঁচ মিনিটেই পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবে শুধু হোমো স্যাপিয়েন্স নামের জীবই না, আরও অনেক জীব। কী ভয়াবহ হবে সেই দৃশ্য! হরর মুভি অথবা ‘দ্য লাস্ট ডে অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ সিনেমার চেয়েও ভয়ংকর সে দৃশ্য হবে! ভাবলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে ওঠে।
আমরা আমাদের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ খাদ্যের জন্য উদ্ভিদের ওপর নির্ভর করি, আমরা শ্বাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন টেনে নিই, তার শতকরা ৯৮ ভাগ আসে উদ্ভিদের কাছ থেকে। তাই উদ্ভিদের ভালো থাকার ওপরই আসলে আমাদের ভালো থাকা, মন্দ থাকা নির্ভর করছে। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আগের তুলনায় বেড়ে গেছে। প্রাক-শিল্প যুগে এই পৃথিবীর পরিবেশ ছিল স্বর্গের মতো, গাছপালারা ছিল সেই স্বর্গীয় উদ্যানের বাসিন্দা। বায়ুদূষণ নেই, জীবাশ্ম জ্বালানির এরূপ ব্যাপক ব্যবহার তখন শুরু হয়নি, তাই বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও ছিল নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু বর্তমানে অতি উন্নয়নের লোভ আমাদের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে পুড়িয়ে মারছে, পুড়িয়ে মারছে গাছপালাগুলোকেও। বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অনেক পোকামাকড় বেড়ে গেছে, সুপ্ত রোগজীবাণুরা বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এসব বালাই হলো উদ্ভিদ বিনাশের এক অন্যতম নিয়ামক। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে এসব ক্ষতিকর জীব ও জীবাণুর বংশবৃদ্ধি বেড়ে গেছে। ফলে আগের তুলনায় এখন উদ্ভিদকুল বেশি রোগগ্রস্ত হচ্ছে, পোকায় ওদের দেহ খাচ্ছে। তাই উদ্ভিদের স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
বনের গাছপালাগুলোর চেহারা দেখার ফুসরত আমাদের হয়তো নেই। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে যেসব ফসল চাষ করি, সেই সব খেতের ফসলে এখন অনেক রোগ-পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে। ভুট্টাগাছে এ দেশে কখনো ‘ফল আর্মিওয়ার্ম’ নামের লেদা পোকার আক্রমণ দেখা যায়নি। ২০১৮ সাল থেকে এ দেশে সেই পোকার আক্রমণ ব্যাপকভাবে দেখা গেছে, যা ভুট্টা চাষকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। যে গমগাছে অতীতে ব্লাস্ট রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে সেই গমগাছে এখন এই রোগ দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গমের ও ধানের চিটা বাড়ছে। অনেক কৃষক এ থেকে ফসল সুরক্ষা দিতে নির্বিচারে রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার করতে দ্বিধা করছেন না। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে, পরিবেশদূষণে আরেক মাত্রা যোগ হচ্ছে। ফলে পরাগযোগকারী সুপতঙ্গরা কমে যাচ্ছে, তাতে উদ্ভিদের বংশরক্ষাকারী বীজেরা গঠিত হতে পারছে না। বীজ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে উদ্ভিদের পুনরুজ্জীবন ঘটবে না। আর উদ্ভিদের প্রাকৃতিক পুনরুজ্জীবন ছাড়া শুধু মানুষের দ্বারা নামকাওয়াস্তে গাছ লাগিয়ে এ ধরিত্রীর পরিবেশ রক্ষা হবে না।