দেশে গণতন্ত্র আর প্রগতিশীল রাজনীতির ধারা ফেরাতে দুই শিশুসন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে ছোট বোন শেখ রেহানার কাছে রেখে নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। পাকিস্তানী ভাবধারা থেকে বাংলাদেশকে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ফিরিয়ে আনা এবং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় বঙ্গবন্ধুকন্যার দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসিত জীবন শেষে প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরে আসা একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
১৯৮১ সালের ১৭ মে। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আলোকবর্তিকা নিয়ে দীর্ঘ নির্বাসন শেষে প্রিয় জন্মভূমির পবিত্র মাটিতে ফিরে আসেন আজকের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। এ দিন ঢাকায় বয়ে যাচ্ছিল কালবৈশাখী, ঝড়ো হাওয়ার বেগ ছিল ঘণ্টায় ৬৫ মাইল। প্রচণ্ড-ঝড়-বৃষ্টি আর বৈরী আবহাওয়া। তাতে কী! শেখ হাসিনা আসবেন তাই কুর্মিটোলা থেকে শেরেবাংলা নগর লক্ষপ্রাণ মুজিবপ্রেমীর ভীড়।
বিকেল সাড়ে ৪টায় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের বোয়িং বিমানে তিনি ভারতের রাজধানী দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে তৎকালীন ঢাকা কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন। সেদিন বৈরী আবহাওয়া উপেক্ষা করে শেখ হাসিনার মাঝে বঙ্গবন্ধুকে খুঁজে পেতে কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে শেরে বাংলা নগর পর্যন্ত এলাকাজুড়ে নামে লাখো জনতার ঢল। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। সেদিনের গগনবিদারী মেঘ গর্জন, ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার বদলা নেওয়ার লক্ষ্যে গর্জে উঠেছিল। আর বৃষ্টির পানি মিশে গিয়েছিল বাঙালির চোখের আনন্দঅশ্রুতে।
শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দরে স্বাগত জানানোর জন্য উপস্থিত প্রায় ১৫ লাখ মানুষের হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসার জবাবে তিনি এদিন বলেন, ‘সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, মানুষের পাশে থেকে মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য আমি দেশে এসেছি। আমি আওয়ামী লীগের নেত্রী হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগের কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, আজকের জনসভায় লাখো চেনামুখ দেখছি। শুধু নেই আমার প্রিয় পিতা বঙ্গবন্ধু, মা আর ভাইয়েরা এবং আরও অনেক প্রিয়জন। শেখ হাসিনা বলেন, ভাই রাসেল আর কোনও দিন ফিরে আসবে না, আপা বলে ডাকবে না। সব হারিয়ে আজ আপনারাই আমার আপনজন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও পরের দিন ১৮ মে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, বিকেল সাড়ে চারটায় আকাশে যখন শেখ হাসিনাকে বহনকারী বিমানটি দেখা যায় তখন সকল নিয়ন্ত্রণ আর অনুরোধ আবেদন অগ্রাহ্য করে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো হাজার হাজার মানুষ ঢুকে যায় বিমানবন্দরের ভেতরে। অনেকটা ঝুঁকি নিয়েই অবতরণ করে বিমানটি। একেবারেই বিমানের কাছে চলে যায় আবেগ আপ্লুত জনতা। বহু চেষ্টার পর জনতার স্রোতকে কিছুটা সরিয়ে ট্রাকটি ককপিটের দরজার একেবারে সামনে নেওয়া হয়। এই সময়ে শেখ হাসিনা ভেতর থেকে জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়েন।