একটা কালো ভোরে মা-বাবা-চাচা, তিনভাই আর দুই ভাইয়ের বউকে হারিয়ে স্বজনহীন শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসেছিলেন, দুঃসহ যন্ত্রণা আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি দেশের সরকার প্রধান। ১৭ মে ১৯৮১ থেকে দেশের সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এখন বিশ্বের শক্তিশালী এবং প্রবীণ সরকার প্রধানদের মধ্যে অন্যতম।
তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সুখের সাগরে ভাসছে ২০০৯ থেকে। কিন্তু কতজন ভেবে দেখে, কতজন স্মরণ করতে চায় ১৯৮১ সালের ১৭ মে যখন দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে শেখ হাসিনা ঢাকায় পা রেখেছিলেন, কী অবস্থা ছিল তার?
১৯৮৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েই বসতে হয়েছিল বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসনে। ১৯৯১ সালে সব সম্ভাবনা থাকলেও আবারও পরাজয়ের স্বাদ পেতে হয়েছে। তাই আজ যারা তার সুদক্ষ নেতৃত্বের প্রশংসা করে গলা ফুলিয়ে তোলেন তারা কি সবাই ভেবে দেখেন—নিঃস্ব-রিক্ত শেখ হাসিনার চলার পথ যে কখনোই কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
বারবার তার জীবন কেড়ে নিতে হত্যা প্রচেষ্টাগুলোর কমপক্ষে তিনটিতে নিজে উপস্থিত ছিলাম বলেই বলছি—ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনার সমালোচনা যারা করেন তারা এই দিকগুলো গুরুত্ব দেন না। এমনকি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের যারা মাস্টারমাইন্ড, তাদেরও ছাড় দেন শুধু রাজনৈতিক বিরোধিতার জন্য। সরকার প্রধান এমনকি আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবেও রাজনীতিক শেখ হাসিনা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন।
কিন্তু যে পথ অতিক্রম করে, সব রাজনৈতিক বিরোধিতা এমনকি দলের অভ্যন্তরেও তা বিবেচনা করেই নিশ্চয় ইতিহাসের পাতায় দেশকে এগিয়ে নেওয়ার মতো একজন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বিবেচিত হবেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সালের ১৭ মে যদি তিনি তেমন বৈরী পরিবেশ সত্ত্বেও দেশে ফিরে না আসতেন, তাহলে এমনটি হতো না। তাই একে দিবস হিসেবে পালনের সময় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন, এইটাই একান্ত প্রত্যাশা।
প্রতি বছর ১৭ মে এলেই আমি বইয়ের সেলফ থেকে একটি বই নামিয়ে রাখি, পড়ি বিচ্ছিন্নভাবে, পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পাল্টিয়ে। প্রস্তাব করবো আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারা পড়ার চেষ্টা করবেন। দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী এবং শেখ হাসিনার স্বামী ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়ার ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ’ বইটি পড়ার জন্য।
মনে রাখবেন, বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে যখন বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। লেখার শুরুতে যে ঝুঁকির কথা বলেছিলাম শেখ হাসিনার জীবনের ব্যাপারে সেই সম্পর্কে এম এ ওয়াজেদ মিয়া লিখেছেন, সকালে নাস্তা খাওয়ার সময় এই প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলে হাসিনা আস্তে আস্তে বলেন, এরইমধ্যে পাকিস্তানপন্থী এবং জিয়ার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশে লিফলেট, হ্যান্ডবিল ইত্যাদি বিলি করে আমার ঢাকায় ফেরা যেকোনোভাবেই প্রতিরোধ করার ডাক দিয়েছে।
আমার মনে হয় জয়-পুতুলকে সঙ্গে নিয়ে আমার ঢাকায় ফেরা সমীচীন হবে না। অতএব, ওদের জন্য তুমি আলাদা আন্তর্জাতিক পাসপোর্টের ব্যবস্থা করো যাতে ওরা রেহানার সঙ্গে লন্ডন যেতে পারে। এ থেকে বোঝা যায় কতটা ঝুঁকি নিয়ে শেখ হাসিনা তখন আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়ে বাংলাদেশে ফিরে এসেছিলেন।