স্বাধীনতার ৫৪ বছরে পা দিতে চলেছি আমরা। ৫৩ বছরে আমাদের অনেক অর্জন যেমন আছে, তেমনি পেয়ে হারানোর বেদনাও আছে। স্বাধীনতার জন্য দীর্ঘ ধারাবাহিক লড়াই-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধু যে চারটি রাষ্ট্রীয় নীতি ঘোষণা করেছিলেন, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা— ৫৪ বছরের মাথায় এসে আমরা এটা খুব গৌরব করে বলতে পারি না যে সেই চার নীতি আমরা কঠিনভাবে আঁকড়ে আছি। কেন এবং কীভাবে আমাদের এই মহৎ অর্জনগুলো দিন দিন উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর না হয়ে এমন ফ্যাকাশে হয়ে পড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সামান্য প্রয়াস হিসেবে আমার ভাবনাটাই সবার সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছি।
আধুনিক বাঙালির বিশিষ্ট জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির নির্মাতা হিসেবে যে তিনজন মহান বাঙালির নাম বিনা দ্বিধায় উচ্চারণ করা চলে তারা হলেন: করুণাসিন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আধুনিক যুগে দুই শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত প্রয়াসের ফল আমরা প্রত্যক্ষ করি এ তিন বাঙালি মনীষীর সার্থক কর্মপ্রচেষ্টায়— উনিশ শতকের ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর, উনিশ-বিশ শতকের ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ এবং বিশ শতকের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু।
বিদ্যাসাগরের জন্ম যদিও উনিশ শতকে, তিনি ছিলেন আঠার-উনিশ শতকের উন্নত বিশ্ব সংস্কৃতির প্রতিনিধি ও বাহক। রবীন্দ্রনাথ উনিশ-বিশ শতকের বিশ্ব সংস্কৃতি আত্মস্থ করে তার সুমহান ফসল দান করেছেন বাঙালিকে। আর বঙ্গবন্ধু বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ জাতীয় ও বিশ্ব সংস্কৃতির মহান ফসল দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিকে। ঘাতকের অস্ত্র অকালে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ হরণ করলেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিভা ও প্রজ্ঞা মধ্য বিংশ শতকের কলহ-বিবাদ, সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও স্নাায়ুযুদ্ধের প্রভাবকে বিদূরিত করে মহৎ মানবতাবাদী চেতনায় পরিশ্রুত করেছে বাঙালির জীবন ও সংস্কৃতিকে এবং বাঙালি জাতিকে মহান মর্যাদায় মণ্ডিত ও অভিষিক্ত করে উত্তীর্ণ করেছে একুশ শতকের বিশ্ব সংস্কৃতির প্রাঙ্গণে।
আমরা মনে করি এ তিনজন মনীষী তিনটি ভিন্ন অঙ্গনে কাজ করে আধুনিক বাঙালি জাতির জাতিসত্তা, সংস্কৃতি ও জাতীয় চেতনাকে গঠন করেছেন। বিদ্যাসাগর তার জ্ঞান, চিন্তা ও কর্ম দ্বারা আধুনিক বাঙালি জাতির চেতনার ভিত্তিভূমি নির্মাণ করেছেন, ধ্যানী রবীন্দ্রনাথ আজীবন শ্রম করে চিন্তার শিখরে আরোহন করেছেন এবং তার চিন্তার ফসল লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ করে বর্তমান ও অনাগতকালের বাঙালির জন্য এবং বিশ্বমানবের জন্যও অক্ষয় মানস সম্পদ রেখে গেছেন। আর গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু তার চিন্তা ও কর্ম দ্বারা অসাম্প্রদায়িক, মানবতাবাদী ও লোকায়ত বাঙালি সংস্কৃতির অবয়ব নির্মাণ করে গেছেন।
বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ বা বঙ্গবন্ধু যে সুউচ্চ স্তরের মানুষ, তাতে তাদের পরস্পরের মধ্যে তুলনামূলক গুরুত্বের বিষয়ে আলোচনা করা সমীচীন নয়। কিন্তু তথাপি আমরা লক্ষ্য না করে পারি না যে, বিদ্যাসাগর বা রবীন্দ্রনাথ সময় ও অবস্থার কল্যাণে যেসব সুযোগ পেয়েছিলেন, সেরকম কোনো সুযোগ না পেয়েও বঙ্গবন্ধু আধুনিকতম মানবিক চিন্তাধারা আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। যেমন, আঠারো, উনিশ ও বিশ শতকের আধুনিকতম ও মহত্তম বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ও মানবতান্ত্রিক চিন্তাধারার সঙ্গে বিদ্যাসাগর ও রবীন্দ্রনাথ পরিচিত হতে পেরেছিলেন তৎকালীন ইউরোপীয় গণতন্ত্রমনা পণ্ডিতদের রচনা পাঠ করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নানা কারণে ওই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। বস্তুত তৎকালে সমগ্র মুসলমান সমাজই নানা কারণে এ সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর সমকালীন অধিকাংশ মুসলিম বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক নেতাই কমবেশি নিজ সম্প্রদায়কেন্দ্রিক চিন্তার প্রভাবাধীন ছিলেন।