একবার ডেনমার্কের অলবোর্গ শহর থেকে বাসে চেপে যাচ্ছিলাম প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার দূরের প্যারিস শহরে। মাত্র ১৬ ঘণ্টার ভ্রমণ পথ। তিন-চার ঘণ্টা পরই খিদে পেল। ব্যাগ থেকে সঙ্গে থাকা কিছু খাবার বের করে খেতে শুরু করলাম।
একটা কমলালেবুও খেলাম। খাওয়ার পর বিপত্তি বাধল, এসি বাস, জানালা-দরজা তো সব আটকা। খাওয়ার পর উচ্ছিষ্টগুলো ফেলব কোথায়? এদিক-সেদিক তাকাচ্ছি। হঠাৎ চোখে পড়ল, সিটের পাশে একটা জিপার লাগানো ব্যাগ ঝোলানো। কী সুন্দর তার চেহারা। এত সুন্দর ব্যাগ কি ময়লা রাখার জন্য? ইতস্তত করছিলাম। আসলে প্রতিটি সিটের পাশে হাতলের সঙ্গে বিশেষ কায়দায় ঝোলানো ব্যাগগুলো কেন রাখা হয়েছে? একবার ব্যাগের দিকে তাকাচ্ছি, আর একবার জানালার দিকে। উড়োজাহাজে এয়ার হোস্টেস থাকে, বাসে সে রকম কেউ নেই যে তাকে ডেকে কথাটা জেনে নেব। আমাদের দেশের মতো না দেখলাম কোনো হেলপার, না পেলাম কোনো কন্ডাক্টর।
ড্রাইভারই অল ইন ওয়ান। ড্রাইভার সাহেবের সিটের কাছেই আমার সিট। আমার ইতিউতি ভাব দেখে শেষে তিনিই আঙুল তুলে বোবাদের মতো ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিলেন, ওগুলো ফেলার জন্যই তো ব্যাগগুলো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। অতএব ফেলো ওখানে, ব্যাগের মুখ আটকাও। তাই করলাম।
আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। একটা ছোট বাসে করে একদিন ডেনমার্কের অরহুস শহরে যাচ্ছিলাম, সঙ্গে ছিল নানা দেশের কয়েকজন। একটা গ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা চলেছি। সঙ্গীদের একজন হঠাৎ জানালা খুলে কী যেন একটা ফেলে দিল। ক্রাচ করে ব্রেক কষে ড্রাইভার সাহেব বাস থামিয়ে দিলেন। তাঁকে বললেন, ‘নামুন, প্লিজ, ওগুলো তুলে আনুন, আমার কাছে দিন। আমি ওগুলো একটা ব্যাগে রেখে দেব। পরে ডাস্টবিনে ফেলব।’
কত ঘটনার কথা বলব! অন্য আরেক দিন কোপেনহেগেন শহরে সেন্ট্রাল রেলস্টেশন থেকে বাসে যেতাম ওয়াইল্ডার প্লাডে ডেনিশ ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান রাইটসে। কয়েক দিন ধরে রোজই সকালে সেখানে যাই। বাস থেকে নেমে কিছুটা পথ হেঁটে সেখানে যেতে হয়।
কিন্তু একদিন সকালে একটা দৃশ্য দেখে সেই ছবি মনের ক্যামেরায় চিরস্থায়ী হয়ে গেল। একজন ডেনিশ ভদ্রলোক একটা সুন্দর কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ কুকুরটা ফুটপাতের ওপরেই মলত্যাগ করে দিল। ভদ্রলোক পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে ফুটপাত থেকে তা তুলে টিস্যুতে মুড়ে আবার তা জ্যাকেটের পকেটে রেখে দিলেন, কুকুর নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলেন।
আমারও কৌতূহল হলো, দেখি না তিনি ওটা কী করেন? কিছু দূর যাওয়ার পর একটা পোস্টের গায়ে ঝোলানো বর্জ্যদানি দেখে তার ভেতর পকেট থেকে সেই সম্পদ বের করে ফেলে দিলেন। ফুটপাতের দিকে তাকিয়ে ভাবলাম, ও দেশের ফুটপাতও আমাদের ঘরের মেঝের চেয়ে কম পরিষ্কার না।দেশের কথা মনে উঠতেই মনের মধ্যে ভেসে উঠল, এসব ক্ষেত্রে আমরা কী করি বা কী করতাম, সেই সব মলিন ছবি। সঙ্গে পাশের দেশেরও কিছু ছবি।