ড. সাজ্জাদ জহির অলাভজনক বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের (ইআরজি) নির্বাহী পরিচালক। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন বিশ্বব্যাংক, আইএফসি, আইএফএডি, ইউনিসেফ, এফএও ও ডব্লিউএফপির মতো প্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক শেষ করে পিএইচডি করেছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোতে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তায়।
শিক্ষা দিয়ে কি আগামী দিনের প্রয়োজন মেটানোর মতো লোক তৈরি হচ্ছে, যারা আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবেন?
ড. সাজ্জাদ জহির: একজন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনাবিদ যদি সব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন, তিনি হয়তো সেই অনুযায়ী জনসম্পদের চাহিদা নিরূপণ করতেন এবং যেসব ক্ষেত্রে জনশক্তির ঘাটতি রয়েছে তা মেটানোর উদ্যোগ নিতেন। অতীতে কিছু কিছু দেশে অতি নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সম্পদের অপব্যবহার দেখা গেছে। তাই অনেকে বাজার ব্যবস্থার ওপর আস্থা রাখেন এবং আশা করেন যে শ্রম চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে মানবসম্পদ গড়ার জন্য ব্যক্তি বিনিয়োগ ঘটবে। তবে প্রযুক্তি পরিবর্তন থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও শ্রম চাহিদায় অনিশ্চয়তা, শিক্ষা-সেবার বাজারের অব্যবস্থা এবং স্বল্পমেয়াদি মুনাফা-তাড়িত স্বার্থান্বেষীদের হাত থেকে ব্যক্তিকে রক্ষা করার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ না থাকায়, ব্যক্তি পর্যায়ের বিনিয়োগ (পর্যাপ্ত সচেতনতার অভাবে) অনেক ক্ষেত্রেই বিপথে চালিত হয়। শিক্ষাঙ্গনে সময়োপযোগী পরিবর্তনের একটি বড় বাধা হলো, গোষ্ঠীস্বার্থের কারণে প্রাতিষ্ঠানিক জড়তা। অর্থাৎ অতীতের ধারায় গড়ে ওঠা (শিক্ষকসহ) অগ্রজরা নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যকে বেছে নেয়ার ফলে নতুন ধ্যানধারণা প্রবর্তন ও কার্যক্রম চালু করা দুরূহ হয়। এ ধরনের একটি বহুমুখী সমীকরণে সরলীকৃত কোনো প্রশ্নের দ্বারা শিক্ষার বিষয়টিকে তরলভাবে না দেখে সামগ্রিক প্রক্রিয়া অনুধাবন প্রয়োজন।
বিষয়টি যদি আরেকটু সবিস্তারে বলতেন?
ড. সাজ্জাদ জহির: শিক্ষার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত, যা বিদ্যালয় পাঠের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। এ আলোচনা বিস্তৃতি পায় এবং অধিক জটিল রূপ নেয় যখন প্রশিক্ষণকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়! একজন পর্যবেক্ষক হিসেবে আমার মনে হয়েছে যে অধিকাংশ মতবিনিময়ে, শিক্ষার দর্শন-বিষয়ক দিকগুলো অনুপস্থিত রয়েছে। বাজারের চাহিদা বুঝে কারিগরি বিদ্যা অর্জন নিঃসন্দেহে আবশ্যিক। কিন্তু একমুখী শ্রমদক্ষতা উন্নয়নের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাজারে নির্দিষ্ট দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা দ্রুত পরিবর্তনশীল। একজন মানুষ একটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছে, কিন্তু প্রযুক্তি বা চাহিদা পরিবর্তনের ফলে সেটা অচল (অবসোলিট) হয়ে যেতে পারে। অথবা সরবরাহ বিভ্রাটের কারণে নির্দিষ্ট উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হলে বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমের লাভজনক ব্যবহার সম্ভব নাও হতে পারে। এ জাতীয় সংকটে একজন বিশেষভাবে দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি কী করবেন? অন্যদিকে যেসব মানুষের সহজাত দক্ষতা রয়েছে, অর্থাৎ যার ভিত পরিশীলিত এবং বিভিন্ন পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে যে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন, শ্রমবাজারে তাদের যোগ্যতা অধিকতর টেকসই। এ পার্থক্যটা আমাদের নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অনেক সময় ভুলে যাচ্ছে। একই ধরনের জড়তা (অর্থাৎ সংবেদনশীলতার অভাবে) প্রশিক্ষণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও ঘটে, যারা অস্তিত্ব রক্ষার্থে পুরনো শিক্ষাক্রম চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে অবস্থান নেয়। এসব কারণে এবং তথ্যপ্রযুক্তি সংগ্রহের (যন্ত্রপাতি ক্রয়ের) নামে ‘পুকুর চুরি’ সম্ভব বলে প্রশিক্ষণের বেড়াজালে মূল্যবান সম্পদের অপচয় ঘটে।