একসময়ের সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ধারাবাহিক রচনা ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ পড়েই ফয়েজ আহমদের ভক্ত হয়ে যাই। তাঁর সাংবাদিক ও রাজনৈতিক জীবনের চমকপ্রদ ও রোমাঞ্চকর ঘটনার বিবরণ পাঠ করতে করতে ভাবতাম, একজন মানুষ কতটা সাহসী, মেধাবী ও কুশলী হলে এমন সব ঘটনার মোকাবিলা করতে পারেন! এরও আগে পত্র-পত্রিকায় তাঁর কবিতা-ছড়া পড়েছি। যখন জানলাম, তাঁর বাড়ি আমাদের পাশের গ্রাম বাসাইলভোগে, তখন একটা অহংবোধ মনে বাসা বাঁধল। ভাবতাম, তাঁর সঙ্গে যদি দেখা করতে পারতাম, কথা বলার সুযোগ পেতাম!
সেই সুযোগও এসে গেল একদিন, ১৯৮৩ সালের শেষ নাগাদ। ফয়েজ আহমদের ছোট ভাই রফিক চৌধুরী তখন দৈনিক সংবাদের শ্রীনগর (বিক্রমপুর) প্রতিনিধি। আমি তখন বর্তমানে লুপ্ত দৈনিক দেশ-এর শ্রীনগর প্রতিনিধি। সে সময় পত্রিকার সংখ্যা যেমন কম ছিল, মফস্বলে সাংবাদিকের সংখ্যাও কম ছিল। রফিক ভাই উদ্যোগ নিলেন শ্রীনগর-লৌহজংয়ের মফস্বল সাংবাদিকদের সমন্বয়ে বিক্রমপুর প্রেসক্লাব গঠনের। রফিক চৌধুরী তখন বড় ভাই ফয়েজ আহমদের তোপখানা রোডের বাসায় সপরিবারে থাকেন। সেখানেই আমরা প্রস্তুতি সভাগুলো করতাম। একদিন ফয়েজ আহমদের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়ে গেল।
আমরা কারা এবং কেন এসেছি জানতে চাইলে রফিক ভাই তা বলার পর তিনি একে একে আমাদের পরিচয় জানলেন। তাঁর ওই বাসায় বসেই রফিক চৌধুরীকে সভাপতি, বাংলার বাণীর অলক কুমার মিত্রকে সাধারণ সম্পাদক ও আমাকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করে বিক্রমপুর প্রেসক্লাবের প্রথম কমিটি গঠিত হয়। ক্লাবটি আজও টিকে আছে। লৌহজং উপজেলার হলদিয়ায় ক্লাবের দ্বিতল ভবন।
উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও ছেলেবেলা থেকেই গরিব-দুঃখী-মেহনতি মানুষের পক্ষে কথা বলতেন তিনি। অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় ফয়েজ আহমদ হাইস্কুলের ছাত্রাবস্থায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাড়ি থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ-ভারতের বিমানবাহিনীতে। তবে যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁর আকাশে ওড়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও মেধাবী ফয়েজ আহমদকে লোভনীয় চাকরি বাদ দিয়ে সাংবাদিকতায় যোগ দিতে উৎসাহিত করে। আর সাংবাদিকতায় এসে তিনি তাঁর দক্ষতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন পদে পদে।
ফয়েজ আহমদ দীক্ষা নিয়েছিলেন বামপন্থী রাজনীতিতে। রাজনৈতিক কারণে তাঁকে কারাবাসীও হতে হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করার পর তিনি কারারুদ্ধ হন এবং একটানা চার বছর বন্দী থাকেন। বামপন্থী রাজনীতি করলেও দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি তাঁর কমিটমেন্টের কমতি ছিল না।
তিনি ছিলেন মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভাবশিষ্য। একই সঙ্গে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরও ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন ছিলেন। ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ফয়েজ আহমদকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার প্রধান সম্পাদক করেছিলেন।