বইমেলা এখন প্রকাশকদের হাট, নাকি ঘুরতে যাওয়া মানুষের মাঠ—তা বোঝা বড় কঠিন। এত মানুষ কেন আসে? এর একটা কারণ হলো, এই শহরে মানুষের আনন্দ করার উপলক্ষ এবং কাঠামো কম। তাই যা কিছু পায় তাতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে নগরবাসী।
বাংলা একাডেমির বার্ষিক অমর একুশে গ্রন্থমেলা ৫২ বছরে পড়ল। ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চিত্তরঞ্জন সাহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে বটতলায় চটের ওপর কলকাতা থেকে আনা ৩২টি বই সাজিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এ ৩২টি বই ছিল চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ, বর্তমানে মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশি শরণার্থী লেখকদের লেখা। তখন বর্ণমিছিলসহ আরও সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়াল ঘেঁষে বই সাজিয়ে বসেন।
সেই থেকে আজকের বৃহৎ পরিসর। একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বইমেলা চলে গেছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও। কিন্তু তবু যেন ঠাঁই হচ্ছে না। গত শুক্রবার মেলায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা একদমই সুখকর ছিল না। আকার ও প্রকার যত বাড়ছে বইমেলার, দর্শনার্থীদের চরিত্র ততই বদলে যাচ্ছে। এত দিন শুনতাম, এবার নিজেই দেখলাম যে এখানে বেশির ভাগ মানুষই বই ছাড়া অন্যান্য আকর্ষণে আসে। বই দেখা, বই কেনার বদলে মেলায় খাওয়া, মেলায় ঘোরা, মেলার মজা নেওয়া, মেলায় আড্ডা দেওয়া, মেলায় সেলফি তোলা এবং টিকটক করার জন্য। একশ্রেণির তরুণ যেভাবে শোরগোল করে, চিৎকার করে তাতে যেকোনো মানুষ দ্বিতীয়বার এই মেলায় যাওয়া নিয়ে ভাববে।
মেলার এক নম্বর সমস্যা অযাচিত ভিড়। যে যেভাবে পারছে, মেলায় ঢুকছে। হাঁটার জায়গার সংকট তো আছেই, বেশি সমস্যা বই দেখা। অনেকে বই কিনতেই যাচ্ছে। গিয়েছিল। কিন্তু পার্কে ঘোরার আনন্দে যারা যায়, তারা আসল বইপ্রেমীদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছ। তাদের চিৎকার, হইহই-রইরই আওয়াজ, টিকটকার আর ভিডিও কনটেন্টমেকারদের পিছে পিছে উচ্চকিত আওয়াজ এমন পরিবেশ সৃষ্টি করছে যে বেশিক্ষণ মেলায় টিকে থাকা দায়। মেলার বর্বর ভিড়ে চ্যাপটা হয়ে বই কেনা বড় কঠিন।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে বইমেলায় যথেষ্ট বই বিক্রি হয়। সেই বই কতটা মানের আর কতটা প্রচারের জোরে, সেটা পরবর্তী বিবেচ্য। কিন্তু যারা মেলায় ঢোকে, তাদের হাতে তো বই দেখা যায় কম। লেখক মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক ব্যক্তিগত একটি জরিপ করে দেখেছেন শতকরা ৭ জন ব্যাগসহ মেলা থেকে বের হয়ে আসে। প্রশ্ন হলো, বাকি ৯৩ শতাংশ লোক তাহলে কেন যায়? অর্থাৎ যত মানুষ আসে, তত মানুষ বই কেনে না। তবে মেলায় ভিড় ঠিকই করছে। ভিড় করছে খাবারের দোকানে। অনেক প্রকাশক আফসোস করে বলেছেন, অতিরিক্ত দামে পানি, চা, কফি আর খাবার কিনছে ঠিকই, কিন্তু বইয়ের বেলায় এসে বলছে দাম বেশি। বইমেলায় পানি, চা-কফিজাতীয় পানীয় বা হালকা স্ন্যাকসের ব্যবস্থা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু একেবারে ভাত-বিরিয়ানির দোকানের অনুমোদন দেওয়া হলো কীভাবে?