বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীকুলের অন্যতম শিরোমণি ছিলেন সাহিত্যিক ও চিন্তক আহমদ ছফা। তাঁর কিছু কথা ভক্তদের কাছে প্রবাদের বিশ্বাস পায়। যেমন তিনি লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না’ (ছফা/বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস)। কথাটায় চমক থাকলেও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য নাই। ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যে দেয়াল ভাঙার সংগ্রাম, সেখানে বুদ্ধিজীবীদের অবদান কম ছিল না। আবার বুদ্ধিজীবীর মগজ থেকে কুবুদ্ধিও কম আসেনি। ছফা সম্ভবত কথাটা বলেছিলেন, উনিশ শতকের কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের রেকর্ড মাথায় রেখে। দেশের স্বাধীনতার চাইতে পশ্চিমা ভাবের জোগালি খাটায় তাদের অনেকের আরাম বোধ হতো। কিন্তু ষাটের বাংলাদেশের বেলায় ওই তত্ত্ব খাটে না।
আহমদ ছফার আরেকটি কথা ঢাকার দরবারি বুদ্ধিজীবীদের মহলে খুব চালু। ছফার বরাতে কথাটা এ রকম: ‘আওয়ামী লীগ যখন জয়লাভ করে তখন একা জয়লাভ করে, আওয়ামী লীগ যখন পরাজিত হয় তখন সমগ্র জাতি পরাজিত হয়।’ বাক্যটার প্রথম অংশটা বাংলাদেশের যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য লাগসই। কিন্তু কোনো একটি দলকে কি সমগ্র জাতির সঙ্গে একাকার করে ভাবা যায়? দল ভুল করতে পারে না? দলের নেতৃত্ব কি ইতিহাসের কোনো বাঁকে ভুল পথ বেছে নিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি করে ফেলতে পারে না? যিনি বলবেন আমার দল সর্বদাই নির্ভুল– তিনি ওই দলের ওপর দেবত্ব আরোপ করলেন। তিনি দোষগুণে মেশানো মানুষী দুনিয়ার নেতৃত্বকে অলৌকিক গুণধারী বলে ভেবে নিলেন। এটা ভক্তিবাদ, যুক্তিবাদ নয়।
এটা ঠিক, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যে দলের নেতৃত্বে দেশ এক হয়েছিল, সেই আওয়ামী লীগ পরাজিত হলে তখন দেশ পরাজিত হতো। কারণ সে সময়ে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু জনগণের বড় অংশেরই নয়, দু-একটি বাদে দেশের প্রায় সব ঘরানার আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করেছিলেন। এমনকি ১৯৭১-এর আগে নেজামে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামের সমর্থনও আওয়ামী লীগ পেয়েছিল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ হয়ে উঠেছিল একটা ঐতিহাসিক সংগ্রামী জোটের নাম। ইতালীয় মার্কসবাদী নেতা ও তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসির ভাষায়, এই ঐতিহাসিক সংগ্রামী জোটকে বলা হয় ‘হিস্টরিকাল ব্লক’। বলা হয়, মার্কসবাদীরা শুধু সর্বহারার শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলেন। আসলে তা নয়, রাশিয়ায় বলি বা চীনে বলি যেখানেই বিপ্লবীরা বিজয়ী হয়েছে, দেখা যাবে, সেখানে তারা বিভিন্ন মিত্র শ্রেণি, গোষ্ঠী, বর্গ, ব্যক্তি ও ভাবাধারাকে একই দিশারি সুতায় বেঁধে ফেলতে পেরেছে। অর্থাৎ একটা হিস্টরিক ব্লক বা ঐতিহাসিক জোট গঠিত হয়েছে। নিজেদের মতপার্থক্য সত্ত্বেও সেই জোট অভিন্ন শত্রুর মোকাবিলা করেছে।