রাজনীতি, বিগ বিজনেস ও ব্যাংক ব্যবসা একাকার হয়ে গেলে কী ঘটতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে আমাদের দেশের অর্থনীতি। এ ত্রৈধ স্পর্শে আমরা আজ নাজেহাল—দেশের ভেতরে ও বাইরে। পুঁজিস্বল্পতা, প্রভিশন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ ও খেলাপি ঋণের ওপর মামলা, তারল্য সংকট, শিডিউলিং-রিশিডিউলিং, পুনর্গঠন ইত্যাদি সমস্যায় আজ আমরা দিশাহারা। ব্যাংক ব্যবসা, মালিকানা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতার নিরিখে এ খাত এখন বিশ্বাসযোগ্যতার তলানিতে। এ অবস্থায় এসে ধরা খেলাম আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে। শর্ত আর শর্ত। সংস্কার, সংস্কার, সংস্কার—যে কথা শুনে আসছি ১৯৯০-৯১ সাল থেকে জোরেশোরে।
দুটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছেড়ে দেয়া হলো বেসরকারি খাতে, বেসরকারি খাতে ব্যাংক বীমার অনুমোদন দেয়া হলো। সরকারি ব্যাংক পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হলো। পুনঃতফসিল, সুদের হার নির্ধারণের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হলো নিজ নিজ ব্যাংকের হাতে। ব্যাংক খাতের ওপর গবেষণার জন্য বিরাট অংকের টাকা বরাদ্দ হলো— কী করা যায় এ খাতের উন্নতির জন্য। দেশের সেরা ব্যাংকারদের নিয়োগ দেয়া হয় ব্যাংক খাতের পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে সুপারিশ তৈরির জন্য। বিশাল বেতন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য বরাদ্দ, বিদেশ ভ্রমণের জন্য বরাদ্দ, প্রকল্প আর প্রকল্প। উদ্দেশ্য ওই ব্যাংককে শক্তিশালী করা, যা দেখে সাবেক অর্থমন্ত্রী প্রয়াত মুহিত সাহেব একবার বকাঝকা করেছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। কত আদেশ, নির্দেশ জারি করা হলো। এক মানি লন্ডারিংয়ের ওপরই কত হুজ্জতি করা হলো—কত প্রশিক্ষণ (ফলাফল দেশের সব টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে)।
এর পর শুরু হয় উল্টো যাত্রা। খেলাপির সংজ্ঞা, সুদ নির্ধারণের ক্ষমতা, ঋণ অনুমোদনে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে একের পর এক পরিবর্তন। সর্বশেষ ছিল ‘নয়ছয়’ অর্থমন্ত্রীর পদক্ষেপ, যার মধ্যে সুদ নীতি অন্যতম। এত সবের মধ্যেই কিন্তু ঘটে যাচ্ছে নানা অনিয়ম আর দুর্নীতি, যার শুরু প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকেই। ১৯৮৩-৮৪ সালে প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকের যাত্রা শুরু। ১৯৯০ সালের দিকেই বিশাল জালিয়াতি। মালিক যারা সরকারি ব্যাংকের ঋণের টাকা দিয়ে ব্যাংকের মালিক হন। তারা চার-পাঁচ বছরের মধ্যে বেনামিতে ঋণ নিয়ে কেলেঙ্কারি করে ফেলেন। কোনো বিচার নেই। ক্রিমিনাল অপরাধ করে সব মাফ। এই যে শুরু, তার আর কোনো শেষ নেই। তিন তিনটি রাজনৈতিক দলের সরকার প্রতিযোগিতা করে ব্যাংকের, নতুন ব্যাংকের অনুমোদন দিল। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা বিনিয়োগের কথা বলে ব্যাংকের অনুমোদন নিল। এর মধ্যে কয়েকজন ব্যাংক লুট করে এখন পলাতক বলে জানা যাচ্ছে। কত আশাবাদ। অর্থনীতি বড় হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানি-রফতানি বাড়ছে। রেমিট্যান্স আসছে। অতএব নতুন নতুন ব্যাংক দরকার। বীমা কোম্পানি দরকার। ব্যাংক যা করতে পারবে না সেই ব্যবসা করার জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান দরকার। অনুমোদন আর অনুমোদন। ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, জীবন বীমা, সাধারণ বীমা কোম্পানির ছড়াছড়ি। সবাই ব্যাংকের মালিক। হাতে হাতে ভিজিটিং কার্ড। আর এক শ্রেণীর লোক বাহবা দিতে শুরু করে। কিন্তু আমরা যে ফাঁদে পড়ছি তা বুঝতে দেরি হয়ে যায়। ছোট ছোট ব্যাংক, নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জেনারেল ম্যানেজার, ফরেন এক্সচেঞ্জ ও ক্রেডিট অফিসারের চাহিদা বেড়ে যায়। ব্যাংকাররা এক ব্যাংক ছেড়ে নতুন ব্যাংকে যান। দক্ষতা, যোগ্যতা, মেধার কিন্তু তত উন্নতি নেই। নিতান্ত চাহিদার বাজারে তারা লাভবান হন। বড় বড় বেতনের চাকরি হয়। কিন্তু এর ফল কী হলো? ব্যাংকাররা নতুন নতুন কাস্টমার তৈরি না করে করল কী—তারা এক ব্যাংকের কাস্টমার ভাগিয়ে অন্য ব্যাংকে নিয়ে যাওয়া শুরু করে। দিতে শুরু করে অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা। এক ব্যাংকের কাস্টমার পেত ১০ কোটি টাকার ফ্যাসিলিটি, অন্য ব্যাংকে তা হয়ে যায় ২০ কোটি। গ্রামে গ্রামে ব্যাংক যায়। প্রতিযোগিতা আর প্রতিযোগিতা।
‘অ্যাগ্রেসিভ ব্যাংকিং’ কাকে বলে। ব্যবসার বিচার নেই, ক্যাশ ফ্লোর বিচার নেই, মর্টগেজ সম্পত্তির যাচাই-বাছাই নেই, শুরু হয় মুখ দেখে ঋণ বিতরণ। যে ১০ টাকা ঋণের উপযোগী তাকে দেয়া হয় ২০ টাকার সুযোগ-সুবিধা। ৫ লাখ টাকা পরিশোধিত মূলধনি কোম্পানি ঋণপত্র খোলে ২০-৫০-১০০ কোটি টাকার। ব্যাংকারদের বড় পার্টি দরকার। বড় ব্যবসা দরকার, প্রফিট দরকার, মালিকরা টার্গেট দিচ্ছেন, টার্গেট পূরণ করলেই বেতন-সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, পদোন্নতি। এক ব্যাংকের ‘জিএম’ সদ্য খোলা নতুন ব্যাংকে দ্বিগুণ বেতনে যান এমডি-ডিএমডি হিসেবে। হই হই রই রই অবস্থা। শেয়ারের ব্যবসা ব্যাংক করবে না। তাদের করতে হবে মার্চেন্ট ব্যাংক। হলো তাই। উত্তেজনা চরমে। পাড়ায় পাড়ায় শেয়ার বিক্রি শুরু হলো। মতিঝিলে কেউ অফিসের কাজ করে না। সবাই ব্যস্ত শেয়ার বেচাকেনা নিয়ে। ফুলেফেঁপে উঠেছে শেয়ারবাজার। ব্যস নামল ধস দুবার। সর্বস্বান্ত লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। এসবই হচ্ছে ব্যাংকের মদদে। ফলে হলো কী? খেলাপি ঋণ বাড়তে থাকল। প্রতিযোগিতা, অহেতুক প্রতিযোগিতা, সীমাহীন প্রতিযোগিতার ফল। মার্চেন্ট ব্যাংকেও খেলাপি। লিজিং কোম্পানিতেও খেলাপি ঋণ বাড়তে শুরু করে। বীমা কোম্পানি দেয় না দাবির টাকা। ক্লেইম সেটেল করে না। আজকের যে খেলাপি ঋণ, আমার মতে তা মাত্রাতিরিক্ত প্রতিযোগিতা বা অ্যাগ্রেসিভ ব্যাংকিংয়ের ফল, টার্গেট-ভিত্তিক প্রতিযোগিতার ফল। অদক্ষ ছোটদের সীমাহীন প্রতিযোগিতার ফল। যে কোম্পানি ১ কোটি টাকার ঋণ পাওয়ার যোগ্য নয়, তাকে দেয়া হয়েছে ৫ কোটি টাকা। অনেক বড় বড় গ্রুপের ক্যাশ ফ্লো নেই। কিন্তু তাদের ব্যাংক ঋণ ২-৫-৭-১০ হাজার কোটি টাকা। জামানত নেই, ব্যবসা নেই, রিশিডিউল হয় না, করতে হচ্ছে রি-স্ট্রাকচারিং। আবিষ্কৃত হয় করপোরেট গ্যারান্টি, পারসনাল গ্যারান্টির। কত সুযোগ-সুবিধা এতে। তবুও টাকা ফেরত আসে না। আদালতে বেঞ্চ নেই। হাজার হাজার কোটি টাকা আটকা রিটে। অর্থঋণ আদালতে জয়ী ব্যাংক—জামানতের সম্পত্তি বিক্রি করতে পারে—ক্রেতা নেই, দরদাতা নেই। ব্যাংকের সম্পত্তি কেউ কিনতে চায় না। বড় গ্রাহক যারা, তাদের মধ্যে যারা খেলাপি হয়েছে তাদের কারখানা-শিল্প কেনার কাস্টমার নেই। দেশেও নেই, বিদেশেও নেই। অনেক মালিক প্রয়াত হচ্ছেন, ছেলেমেয়ে-স্ত্রীর মধ্যে মারামারি। অনেক মালিকের ছেলেমেয়েরা তছরুপ করা টাকা ভোগ করছে বিদেশে, দেশে আসবে না। এ অবস্থায় পথ খুঁজছি আমরা।