২০২৪ সালের প্রথম দিনই আমাদের তৃতীয় শ্রম আদালত বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে একজন প্রবল পরাক্রমশালী ব্যক্তির বিরুদ্ধে রায় প্রদান করে আইনের শাসনের মন্ত্রকে জীবিত রাখতে হয়। আদালত নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে শ্রম আইনের বিভিন্ন ধারা লঙ্ঘনের জন্য ৬ মাস কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
এটি দেখার মতো যে উল্লেখিত রায়টি অশেষ ক্ষমতাশালী সাংবিধানিক আদালত, অর্থাৎ হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্ট প্রদান করেনি, করেছে নিম্ন আদালতের শ্রেণিভুক্ত এক বিচারালয়। রায়ের আগে অনেকেই এই নিয়ে চিন্তিত ছিলেন যে শ্রম আদালত হয়তো ইউনূসের মতো একজন মহা শক্তিমান লোকের বিরুদ্ধে রায় দিতে সাহস করবে না। কিন্তু সকলের হেন উৎকণ্ঠা জলে ফেলে দিয়ে ওই আদালত প্রমাণ করল বাংলাদেশের উঁচু-নিচু কোনো আদালতই ব্যক্তিবিশেষের প্রভাব বলয় দেখে বিচার করে না। বিচার করে ন্যায়দণ্ড সামনে রেখে।
ড. ইউনূস যে শুধু একজন নোবেল বিজয়ী, তা নয়। তিনি এক সময়ের মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। যুক্তরাষ্ট্রে তার প্রভাব এতটাই প্রখর যে বলা হয়ে থাকে তিনি পদ্মা সেতুতে প্রতিজ্ঞাকৃত ঋণ প্রদান থেকে বিশ্বব্যাংককে বিরত রাখতে সফল হয়েছিলেন মার্কিন সরকারের সহায়তায়। গোটা বিশ্বের কাছে ড. ইউনূসকে মার্কিন সরকারই পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বদান্যতার কারণে তিনি জাতিসংঘেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করতে পেরেছেন। এমন এক দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্যক্তিকে সাজা প্রদান করা সহজ ছিল না। কিন্তু সেই কঠিন দায়িত্বটি পালন করে তৃতীয় শ্রম আদালত প্রমাণ করলো যে ভয়হীনভাবে বিচার করাই আইনের শাসনের অমোঘ নির্দেশ, যে নির্দেশ বাংলাদেশের বিচারকগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
চার শতাধিক বছর আগে প্রখ্যাত বৃটিশ মনীষী ডা. থমাস ফুলার বলেছিলেন “তুমি যত বড়ই হও না কেন, আইন তোমার চেয়েও বড়।” সেই অমূল্য বাণী ষাটের দশকে যুক্তরাজ্যের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম বিচারক হিসেবে পরিচিত লর্ড ডেনিং পুনরোল্লেখ করেছিলেন বৃটিশ অ্যাটর্নি জেনারেল (যিনি যুক্তরাজ্যের একজন মন্ত্রী) এর বিরুদ্ধে রায় প্রদানকালে। সেই অখ-নীয় বাণীতেই রয়েছে আইনের শাসনের মূল মন্ত্র, যে নীতি নিশ্চিত করে বঙ্গবন্ধু এটিকে আমাদের সংবিধানে স্থান দিয়েছিলেন। একই নির্দেশনা রয়েছে ১৯৪৮ সালে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায়ও। বিগত ১৫ বছর ধরে আমাদের আদালতসমূহ এই তত্ত্বের প্রতি রয়েছে অবিচল।