রোহিঙ্গারা তাদের বাসভূমি মিয়ানমার থেকে স্থানীয় রাখাইন ও মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর গত ছয় বছরেরও বেশি সময়ে নিজ দেশে তাদের গ্রহণযোগ্যতা ও দৃঢ় অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। এখনো রোহিঙ্গারা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে মিয়ানমার থেকে বিপৎসংকুল সাগরে ভেসে চলছে নানা দেশের দিকে।
তাদের নেতৃত্ব এ সংকট সমাধানে সক্ষমতা দেখাতে পারছে না। রোহিঙ্গাদের স্বার্থ নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোও এ ব্যাপারে কতটুকু এগিয়েছে, তাও স্পষ্ট নয়। বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী জাতিগত সশস্ত্র দলগুলোর (ইএও) সমন্বিত আক্রমণে পর্যুদস্ত। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স গত অক্টোবরে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান শুরু করে। তাদের হামলা শুরু হলে ২০২১ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে সামরিক জান্তা। ন্যাশনালন ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) দেশের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ন্ত্রণের দাবি করছে। তারা কূটনৈতিকভাবে জান্তা সরকারকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে। এনইউজি সমর্থিত পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের (পিডিএফ) কমান্ডে অন্তত ৩০০ ইউনিট রয়েছে। ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স ২৭ অক্টোবর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ৪২২টি সেনাঘাঁটি ও সাতটি শহর দখল করে নিয়েছে। এ সমন্বিত আক্রমণে চীন, থাইল্যান্ড ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্য রুট এবং বাণিজ্য ক্রসিং পোস্টগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বিভাগসহ এক ডজন টাউনশিপ ইএওগুলোর দখলে এসেছে। বর্তমানে মিয়ানমারের প্রায় ৫২ শতাংশ এলাকা ইএও’র কার্যকর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
মিয়ানমারের প্রতিরোধ যোদ্ধারা ধর্মীয় ও জাতিগত বিভাজন ভুলে সবাই একসঙ্গে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করছে। মিয়ানমারের চিন রাজ্যে বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টানরা মিলে জান্তার বিরুদ্ধে চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্সে (সিডিএফ) একত্রে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে লড়াই করছে। সিডিএফ চিন রাজ্যের খ্রিষ্টানদের নিয়ে গঠিত, তবে এতে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগত ও ধর্মীয় গোষ্ঠী বামার বৌদ্ধরাও রয়েছে। অভ্যুত্থানের পর থেকে জান্তা বৈধতার জন্য মিয়ানমারে ধর্মীয় বিভাজনের দিকে ঝুঁকেছে। জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং বৌদ্ধধর্মের রক্ষক হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করে বৌদ্ধধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে বিভিন্ন জাতিগত এবং ধর্মীয় যোদ্ধারা নিজেদের এক পরিবারের অংশ মনে করে এবং তাদের শত্রু এখন শুধু মিয়ানমার সামরিক বাহিনী। বিভিন্ন জাতিগত, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক পটভূমির যুবকরা প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছে। তারা একটা আদর্শ মিয়ানমার চায়, যেখানে সব জাতি ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর সঙ্গে সমান আচরণ, বাক্স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক সুযোগ থাকবে।
মিয়ানমারে বহু দশক ধরে সেনাবাহিনীর প্রতি বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সমর্থন সেনাবাহিনীর মনোবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে আসছিল। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মধ্যে বিভক্তি ও সেনাবাহিনীর প্রতি একতরফা সমর্থন হ্রাসের কারণে অনেক সাধারণ মানুষও সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের সমর্থন থেকে সরে এসেছে। মিয়ানমারের সব ভিক্ষু বর্তমান সেনাশাসন সমর্থন করেন না। এখন বৌদ্ধ মঠগুলোতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হচ্ছে এবং সেখান থেকে অনেকে সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছেন। একসময় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ঘৃণা ছড়িয়েছিল। এখন অনেক নেতৃস্থানীয় ভিক্ষু মনে করেন, মা বা থা ভিক্ষুরা উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ঘৃণা না ছড়িয়ে রাখাইনের উন্নয়নের জন্য সক্রিয় হলে জনগণের জীবনমানের উন্নতি হতো এবং দেশে শান্তি বিরাজ করত। চলমান প্রেক্ষাপটে ভিক্ষুরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন, তাদের নিজস্ব অহিংস প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন এবং সীমান্তবর্তী জঙ্গলে ছাত্রদের সঙ্গে অল বার্মা ইয়াং মঙ্কস ইউনিয়ন নামে সংগঠিত হয়ে প্রতিরোধে অংশ নিচ্ছেন। জাতিধর্মনির্বিশেষে সংগঠিত এ সমন্বিত কার্যক্রমে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলে তা জাতিগত সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে ও রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।