১৪ ডিসেম্বর আমরা ছিলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কর্মী হিসেবে প্রবাসে। প্রবাস থেকেই খবর পেয়েছিলাম আমাদের প্রিয় মানুষ বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তির নায়কদের পাকিস্তানের দোসররা তুলে নিয়ে গেছে। তাঁদের কোনো খোঁজও পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁদের তুলে নিয়ে গেছে, তাঁদের কারও কারও সঙ্গে আমাদের খুব নিবিড় সম্পর্ক ছিল। সুদীর্ঘ সময় ধরে সমাজে তাঁদের অবদান আমরা দেখে এসেছি। তাঁদের শ্রদ্ধা করেছি, ভালোবেসেছি। আবার তাঁরা যে ঢাকা শহর ছেড়ে চলে যাননি, তার জন্য ক্ষুব্ধও হয়েছি। কারণ এই শহর তখন কোনো অবস্থাতেই কোনো দেশপ্রেমিকের জন্য নিরাপদ ছিল না।
‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিতে গিয়ে শহীদুল্লা কায়সারের সঙ্গে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আমার তৈরি হয়েছিল। শুধু শহীদুল্লা কায়সার নন, তাঁর পরিবারের সঙ্গেও। প্রায়ই সকাল বেলায় তাঁর কায়েতটুলির বাসায় যেতাম, টেলিভিশনের জন্য ‘সংশপ্তক’-এর নাট্যরূপের পাণ্ডুলিপি নিয়ে। শহীদুল্লা কায়সার তখন সংবাদের অফিসে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে সকালের নাশতা করছেন। শিশু পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে তাঁর ভোরবেলার খেলা। কোলে বসিয়ে কাউকে তিনি দুধ খাওয়াচ্ছেন। তিনি স্যুট পরতে ভালোবাসতেন, স্যুট পরেই এই কাজটি করতেন। কোলে বসিয়ে সন্তানদের দুধও খাওয়াতেন। প্রথম প্রথম একটু অবাক লাগত। একজন জেলখাটা কমিউনিস্ট, যিনি তাঁর অসাধারণ শিল্পগুণসমৃদ্ধ ‘সারেং বউ’ বা ‘সংশপ্তক’ লিখেছেন, কী গভীর গ্রামীণ জীবনের আখ্যান রচয়িতা, তিনি স্যুট-প্যান্ট কী করে পরেন! নিজেই ফক্সওয়াগন গাড়ি চালান আবার সংবাদের সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন।
পরবর্তীকালে আমি যখন ‘ওরা কদম আলী’ নাটক লিখি, বিভিন্ন জায়গায় আমি প্রশ্নের সম্মুখীন হই—কী করে আমিও স্যুট পরি এবং দামি সিগারেট খাই! একবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের সামনে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলাম। তখন জবাবে বলেছিলাম, আপনারা একটু চিন্তা করুন আমার নাটকের নাম ‘ওরা কদম আলী’, আমি কিন্তু বলিনি আমরা কদম আলী। আমি তো কদম আলী নই, কদম আলীদের জন্য লিখেছি। কদম আলী হলে আমি লিখতে পারতাম কি? সেই থেকে এতগুলো বছর যে শ্রেণিসংগ্রামের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছি, একটা মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করে তা কি সম্ভব হতো? পৃথিবীতে আমার নমস্য যাঁরা—ম্যাক্সিম গোর্কি, তলস্তয়, আন্তন চেখভ, বের্টল্ট ব্রেখট, শেক্সপিয়ার—তাঁরা কি কদম আলী শ্রেণির মানুষ?
যাই হোক, সেই অসাধারণ লেখক শহীদুল্লা কায়সারকে আমরা হারালাম, হারালাম মুনীর চৌধুরীকে, যিনি আধুনিক নাটকের জন্ম দিয়েছিলেন। আরও কিছু অসাধারণ সাংবাদিক, যাঁরা এই পেশাকে বেছে নিয়ে নিদারুণ দারিদ্র্যকে গ্রহণ করেছিলেন। তখনকার দিনে সাংবাদিকদের অর্থনৈতিক জীবন আজকের দিনে কল্পনাই করা যায় না। যেসব পত্রিকা তখন বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ছিল, তার সাংবাদিকেরা কেউই নিয়মিত বেতন পেতেন না, বেতনকাঠামোও তৈরি হয়নি তখন। মাসের পর মাস অনেক সাংবাদিক বেতন পেতেন না। কিন্তু লেখালেখিতে তাঁরা ছিলেন বিপ্লবী। ব্যাপারটি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল। তারা দেশটাকে মেধাশূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের বেছে নিয়েছিল।
আবার যেসব চিকিৎসক গণমানুষের কাছে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়, যাঁরা চিকিৎসার জন্য ধনী-গরিব বিবেচনা করতেন না, সামান্য ভিজিট নিয়ে কিংবা না নিয়েই মানুষের চিকিৎসা করতেন, তাঁরাও হানাদারদের টার্গেট হয়ে পড়লেন। কী নিষ্ঠুর বিবেচনা! কিন্তু ওই সব চিকিৎসক ভেবেছিলেন—আমরা তো মানুষের সেবা করি, আমাদের কী অপরাধ? সেই অপরাধটাই পাকিস্তানিদের কাছে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ল, তাদের হত্যা করল। তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন চক্ষু চিকিৎসক ডা. আলীম চৌধুরী। তিনি রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগদান করেন। কত অন্ধজনকে তিনি চোখের আলো ফিরিয়ে দিয়েছেন, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। তাঁকেও হত্যা করল পাকিস্তানি বাহিনী ও এদেশীয় দোসররা।