‘আমি গত ১১ বছর ধরে মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজ করছি। বর্তমানে আমার বেতন ১০,৭০০ টাকা। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত কাজ করি। আমার দুই সন্তানকে ঘরে রেখে কাজে আসি। এই টাকায় আমার মাসের ১৫ দিনও চলে না।’ একটি গণমাধ্যম তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পেইজে ‘বেতন বাড়াতে সমস্যা হলে নিত্যপণ্যের দাম কমান’ শিরোনামে একজন পোশাক শ্রমিকের কথা উদ্ধৃত করে একটি কার্ড শেয়ার করে। গত তিন দিনের ঘটনাপ্রবাহে কার্ডটি বহু মানুষ নিজেদের প্রোফাইলে শেয়ার করেছেন, যা ওই শ্রমিকের মর্মস্পর্শী কথার বাস্তবতাকেই তুলে ধরে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত ক্রমে সম্প্রসারিত হচ্ছে, রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছে, মালিকদের আয় এবং সম্পদ বাড়ছে, কিন্তু মজুরি নিয়ে শ্রমিকের অসন্তোষ কমছে না। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্পে বিশ্বে দ্বিতীয়, সে প্রথম হতে চায় কিন্তু মজুরি দিতে চায় না। মজুরির প্রশ্ন ছাড়াও, প্রতি ঈদের আগে বকেয়া পাওনাসহ নানা রকম দাবি পূরণে পোশাক শ্রমিকদের কমবেশি বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তায় নেমে আসতে হয়। প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের শ্রমিকদের জন্য সহযোগী সংগঠনগুলো কী করে?
একসময় শুধু শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার্থে নয়, শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল জাতীয় রাজনীতিতেই। কিন্তু পরবর্তী সময়ে রাজনীতিতে শ্রমিক নেতাদের প্রভাব দেখা গেছে কমই। অন্যদিকে জাতীয় রাজনীতিতেও শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া সংগ্রামও সেভাবে উঠে আসতে দেখি না। বাংলাদেশে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত যতবার শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করেছে, তার প্রতিটিই শেষ পর্যন্ত বড় বড় রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, অন্যভাবে বললে, রাজনীতির প্রতিটি বাঁক বদলে ছিল শ্রমিক আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু এখন আর বাংলাদেশে শ্রমিক আন্দোলনের স্বর্ণযুগ নেই। এখন শ্রমিক আন্দোলন হয় ঠিকই কিন্তু সেগুলো স্থায়িত্ব পায় না, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, উত্তেজিত শ্রমিকরা হুট করে রাস্তায় নেমে আসে। তারা বিক্ষোভ করে, ভাঙচুর করে, আবার নেতৃত্বের অভাবে তারা অনেক ক্ষেত্রেই দিন শেষ হওয়ার আগেই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
এখানেই প্রশ্ন জাগে কেন শ্রমিকরা বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা দেশের শ্রমিক আন্দোলন-সংগ্রামের সেই শক্তি হারাল? এর পেছনে অনেকে পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাইভেটাইজেশনকে একটা কারণ বলে মনে করেন। এই খাতে ট্রেড ইউনিয়ন করার আইনগত সুযোগ থাকলেও, নানা পন্থায় মালিকরা সেটা করতে দিচ্ছেন না। শিল্প পুলিশ যেটা তৈরি হয়েছে সেটা পুরোপুরিভাবে মালিকদের স্বার্থরক্ষায় কাজ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া এই সেক্টরে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা ৬৫টি ফেডারেশনের বিভক্তিও তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পেছনে বাধা হিসেবে কাজ করছে বলে অনেকের ধারণা।