বলিউডের হিন্দি চলচ্চিত্র দক্ষিণাঞ্চলীয় চার রাজ্য ছাড়া ভারতজুড়ে প্রদর্শিত হয়। কিন্তু দক্ষিণের চার রাজ্য যথাক্রমে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্র ও কেরালায় হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতি তারা প্রবলভাবে রুখেছে। তাই হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্র সেখানে প্রদর্শিত হতে পারে না। ওই চার রাজ্যের পৃথক চার ভাষা তামিল, কন্নড়, তেলেগু ও মালয়ালম ভাষার বিকল্প ভাষাটি হিন্দি নয়; ইংরেজি। হিন্দি চলচ্চিত্র ‘জওয়ান’ ওই চার রাজ্যে তাই উপস্থিত হয়েছে চার পৃথক ভাষায় ডাবিং নিয়ে। অথচ বাংলাদেশে ছবিটি বাংলায় ডাবিং না করে নির্ভেজাল হিন্দি ভাষায় প্রদর্শিত হচ্ছে। কী বিচিত্র দেশ, সেলুকাস!
মাতৃভাষার জন্য লড়াইয়ে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার মাধ্যমে আমরা বিশ্বে নজির স্থাপন করেছিলাম। পাকিস্তানের স্রষ্টা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দু ভাষা চাপাতে এসেও রেসকোর্সে এবং কার্জন হলের বক্তৃতা উর্দুতে নয়; ইংরেজিতে দিয়েছিলেন। তারপরও ওই বক্তৃতাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে মিছিলে থাকা আমরা সড়কের পাশে উর্দু ও ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড নির্বিচারে ভেঙেছিলাম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে জেল-জুলুম, প্রাণদান করে মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম। সেই আমরাই স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দি ভাষার আমদানীকৃত ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে আমরা হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতির আগ্রাসন সানন্দে বরণ করে নিলাম? এটি ইতিহাসের কৌতুক ভিন্ন আর কী বলা যায়?
এটা ঠিক, কেবল টিভির কল্যাণে হিন্দি ভাষা-সংস্কৃতি আমাদের ঘরে ঘরে অনেক আগেই ঢুকে পড়েছে। তাই বলে হিন্দি ভাষার ‘জওয়ান’ ছবিটি আমাদের দেশের প্রেক্ষাগৃহেও জোরকদমে প্রদর্শিত হবে?
পাকিস্তানিরা বল প্রয়োগেও আমাদের ওপর উর্দু ভাষা চাপাতে পারেনি। অথচ ভারতের সরকারি ভাষা হিন্দি আমরা সানন্দে গ্রহণ করছি। এই অবক্ষয় আমাদের জাতীয় জীবনে বিশেষ করে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিতে বিরূপ প্রভাব যে ফেলতে পারে– রাষ্ট্র ও সরকার তার সামান্য বিবেচনা না করে হিন্দি ভাষার ‘জওয়ান’ ছবিটি প্রদর্শনের অনুমতি দিল কেন? আমাদের প্রতিটি শাসকই নিজেদের জাতীয়তাবাদী পরিচয় দিয়ে এসেছে। তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা যে ফাঁপা– হিন্দি ভাষার ভারতীয় চলচ্চিত্র প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়ার মধ্য দিয়ে সেটা স্পষ্ট। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প মুনাফালিপ্সায় এখন প্রায় বসে পড়েছে। সুস্থ বিনোদনের বিপরীতে স্থূলতার কারণে মানুষ প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখা অনেক আগেই প্রায় ত্যাগ করেছে। এ অবস্থায় ভারতীয় হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রের অনুপ্রবেশ কি আমাদের মুখ থুবড়ে পড়া চলচ্চিত্র শিল্পের কবর রচনা নয়?