যাদবপুরে যে মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে ও হবে, প্রতিবাদ হয়েছে ও হবে। এখন এটি আইনের দখলে চলে গেছে, আইন তার পথ ধরে চলবে (আশা করি)। নিশ্চয়ই অপরাধীদের শাস্তি লঘু করার জন্য তাদের শুভানুধ্যায়ীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন, সেটা তাদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। আমি এ চেষ্টাগুলোকে অবৈধ বলি না। কিন্তু স্বপ্নদীপের ওপর নৃশংস অত্যাচার আর তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যে অমার্জনীয় অপরাধ এবং এ অপরাধের ‘দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি’ হওয়া দরকার, এ সম্বন্ধে কোনো দ্বিমত কোথাও থাকার কথা নয়। যদিও আমি খুব সংশয়ে আছি, শেষ পর্যন্ত কতদূর কী হবে তাই নিয়ে। অপরাধীদের বাঁচাতে কোনো ‘প্রভাবশালী মহল’ (শুধু রাজনৈতিক অর্থে নয়) নেমে পড়বে কিনা তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। এখনই ‘এ আমার এ তোমার পাপ’ গোছের একটা ধুয়ো উঠেছে, কোথাও ক্ষীণ একটা সহানুভূতির ঢেউও যেন জাগছে-কারও জীবন বা কেরিয়ার নষ্ট হতে চলেছে, এ আশঙ্কা কেউ কেউ প্রকাশ করছেন। আমার ধারণা, এটি একটা নির্লজ্জ শ্রেণি-পক্ষপাত। অপরাধীরা লেখাপড়া করা (‘শিক্ষিত’ বলতে চাইছি না, সবাই তা নয়) মধ্যবিত্ত সন্তান না হলে, অর্থাৎ ‘আমাদের’ অংশ না হলে এ সহানুভূতির হাওয়া উঠত না। যদি খুনিরা, দাগি অপরাধী না হলেও, তথাকথিত ‘ভদ্রলোক’ সমাজের বাইরের ‘ওরা’ হতো, তাহলে এ চাপা দীর্ঘশ্বাস কি তৈরি হতো? যে শ্রেণিই করুক, অপরাধ অপরাধই, তা-ও সজ্ঞানে বীভৎস অত্যাচার আর খুন। ‘দৃষ্টান্তযোগ্য শাস্তি’ বলতে সবাই যা বোঝে, আমিও তাই বুঝি, যাতে এ অপরাধ বা অপরাধের ইচ্ছা চিরকালের মতো বন্ধ হয়। কিন্তু শুধু এই একটা মাত্র কাজ করলে সব সমস্যার সমাধান হবে না। আবার আমার এ কথার মধ্যে যেন কেউ অপরাধীদের প্রতি সহানুভূতি না দেখেন। স্বপ্নদীপের মতো একটি ছেলের খুনিদের যে শাস্তি প্রাপ্য, তা তাদের দিতে হবে।
এ অপরাধের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন দায়ী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং সর্বোচ্চ স্তরের প্রশাসন। তাদের দীর্ঘদিনের শৈথিল্য এ ব্যবস্থাকে প্রশ্রয় দিয়েছে, উৎসাহ দিয়েছে। উপাচার্য, নিবন্ধক ইত্যাদিরা এসেছেন আর গেছেন (এখন আরও খুব তাড়াতাড়ি আসেন আর যান, আগেকার দিনের সিনেমার ফাস্ট মোশনের দৃশ্যের মতো), কিন্তু কেউ ভীমরুলের চাকে ঘা দেওয়ার সাহস করেননি। তার বিরুদ্ধে নানা আন্দোলনের ফলে একজন প্রভূত অজনপ্রিয় পদত্যাগকারী উপাচার্য নাকি এসব ভালো কাজ করেছিলেন বলে এখন দাবি করছেন, সে সম্বন্ধে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলতে পারবেন। নেশার আড্ডা তৈরি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের রাস্তায়, তা-ও বন্ধ করা যায়নি। কাজেই শুধু অপরাধীদের শাস্তি দিলে এ অনাচার বা অপরাধ বন্ধ হবে তা নয়। প্রশাসনকে অনেক অপ্রিয়, কিন্তু বজ কঠিন পদক্ষেপ নিতে হবে। তারাও শ্রেণি-পক্ষপাতে ভোগে; ভাবে, ‘আহা, এরা তো আমাদেরই ঘরের ছেলেমেয়ে!’ রাজ্যের শিক্ষা-প্রশাসন এ বিষয়টায় এখন নজর দিচ্ছে এ-ও খুব ভালো কথা। অনেক আগেই নজর পড়লে হয়তো ভালো হতো। ইউজিসি তো সেই কবে থেকেই অ্যান্টি-র্যাগিং বিধি চালু করেছে। এটা সারা দেশের অভিশাপ বলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ‘স্বাধিকার’ আছে বলে এ অন্ধকার দিকগুলো সম্বন্ধে উদাসীন থাকা উচিত হয়নি।