মাসাধিককাল ধরে রবীন্দ্ররচনা খুব বেশি পড়ছি। কেন পড়ছি তার একটা কারণ অবশ্য আছে। কোনো একটি ঘটনা আমাকে খুব বিচলিত করেছিল। বিধ্বস্ত করেছিল বললেও অত্যুক্তি হবে না। দিনমান একটা প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়িয়েছি। পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, এই পড়াগুলো খুব দরকার। কেননা পাঠ্যবই পড়ে আমরা বড়জোর একটা চাকরির উপযুক্ত হই। দায়িত্বশীল, মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষ কি হই?
যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথের বিচারক গল্পটির কথাই যদি বলি, গল্পে হেমশশী পাশের বাড়ির মোহিতের ভালোবাসায় উথলিত হয়ে তাকে দেবতুল্য জ্ঞান করে একদিন গভীর রাতে বাবা, মা, ভাই এবং ঘর ছেড়ে মোহিতের সঙ্গে একই গাড়িতে উঠে বসে। একসময় গাড়ি ছেড়ে দিলে তার বোধের রাজ্য জেগে ওঠে।
‘জলনিমগ্ন মরণাপন্ন ব্যক্তির যেমন মুহূর্তের মধ্যে জীবনের সব ঘটনাবলি স্পষ্ট মনে পড়ে, তেমনি সেই দ্বাররুদ্ধ গাড়ির গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে হেমশশীর মনে পড়িতে লাগিল, প্রতিদিন আহারের সময় তাহার বাপ তাহাকে সম্মুখে না লইয়া খাইতে বসিতেন না; মনে পড়িল, তাহার সর্বকনিষ্ঠ ভাইটি ইস্কুল হইতে আসিয়া তাহার দিদির হাতে খাইতে ভালোবাসিত; মনে পড়িল, সকালে সে তাহার মায়ের সহিত পান সাজিতে বসিত এবং বিকালে মা তাহার চুল বাঁধিয়া দিতেন। ঘরের প্রত্যেক ক্ষুদ্র কোণ এবং দিনের প্রত্যেক ক্ষুদ্র কাজটি তাহার মনের সম্মুখে জাজ্বল্যমান হইয়া উঠিতে লাগিল। তখন তাহার নিভৃত জীবন এবং ক্ষুদ্র সংসারটিকেই স্বর্গ বলিয়া মনে হইল। সেই পান সাজা, চুল বাঁধা, পিতার আহারস্থলে পাখা করা, ছুটির দিনে মধ্যাহ্ননিদ্রার সময় তাঁহার পাকা চুল তুলিয়া দেওয়া, ভাইদের দৌরাত্ম্য সহ্য করা—এ-সমস্তই তাহার কাছে পরম শান্তিপূর্ণ দুর্লভ সুখের মতো বোধ হইতে লাগিল; বুঝিতে পারিল না, এ-সব থাকিতে সংসারে আর কোন্ সুখের আবশ্যক আছে।