জনপ্রিয় আরবি উপকথা দিয়ে বিষয়ে ঢোকা যাক। এক হতদরিদ্র কাঠুরিয়া গভীর বনে গিয়ে কাঠ কাটত। কাঠগুলো কাঁধে বয়ে এনে বাজারে বেচত। এভাবে কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালাত। শরীরে পুষ্টি নেই; কাঠের বড় আঁটি কাঁধে তোলা যাচ্ছে না; এদিকে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার মনে হলো, এই দুর্বহ জীবন টেনে চলার চাইতে মরে যাওয়াই ভালো। সে চিৎকার করে বলল– আজরাইল, তুমি কোথায়? আমাকে কি তোমার চোখে পড়ে না? তুলে নিতে পারো না? এমন সময় এক দশাসই তাগড়া জোয়ান পথ আগলে দাঁড়াল। বলল– ডাকাডাকি করছিলে কেন? আমিই আজরাইল। কাঠুরিয়া বলল– কাঠের আঁটিটা আমার মাথায় তুলে দেওয়ার জন্য তোমাকে ডাকছিলাম। খুব বেশি ভারী তো!
ফ্রয়েড একেই বলেছেন ‘লাইফ ইন্সটিঙ্কট’। নবী ইউনুস (আ.) মাছের পেটে গিয়েও জীবনের দরুদ পাঠ করেন। ডাইনোসর-ড্রাগন, বাইসন, পাইথনকে হটিয়ে মানুষের স্বরাজ অর্জন জীবনের প্রয়োজনেই। গভীর সমুদ্রে পড়া মানুষ ভাসমান কুটো ধরে বাঁচতে চায়। অজগর বা ক্ষুধার্ত সিংহের পেটে ঢুকতে ঢুকতেও মানুষ বাঁচতে চায়। রবিনসন ক্রুশোর গল্প, ক্যাস্ট অ্যাওয়ে চলচ্চিত্রের কাহিনিসহ অসংখ্য গল্প রয়েছে জীবনতৃষ্ণার। সম্পর্ক থেকে মানসিক আশ্রয়ের আশা উঠে গেলে জীবনবিতৃষ্ণা তৈরি হয়। আশ্রয়টি টিকে থাকলে জীবনতৃষ্ণা বাড়ে।
মাস কয়েক আগে মিরপুর-পল্লবী এলাকায় দেখলাম, একজন মধ্যবয়সী অসুস্থ মানুষ একটি ভ্যান টানছেন। ভ্যানে তাঁর অশীতিপর মা। মরার মতো পড়ে আছেন। ভ্যান থেকে পায়খানা-প্রস্রাবের গন্ধ বেরোচ্ছে। ভ্যানওয়ালা নিজেও অসুস্থ। সারা শরীর ফোলা। কিডনি দুটোই নষ্ট। নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয়। বাইপাস হয়েছে। শরীর শক্তিহীন। মায়েরও বার্ধক্যজনিত জটিল অসুখ-বিসুখ। চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। মানুষের কাছ থেকে সাহায্য নিয়েই দু’জনের চিকিৎসা চলে। অন্য সবার মতো আমিও সন্দেহ করেছিলাম। ভেবেছিলাম, ‘ব্যবসার নতুন ধরন’। দীর্ঘ সময় নিয়ে নানাভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হলাম– লোকটি বেঁচে থাকতে চান শুধু মাকে দেখভাল করার দরকারে। সাতকুলে তাঁদের আর কেউ নেই। মাও বেঁচে আছেন শুধুই সন্তানটির জন্য। নড়চড়-শক্তিহীন। তবু বলেন, আমি মরে গেলে আমার ছেলেকে কে দেখবে?