মুক্তিযুদ্ধ সমাপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশ প্রেস ইন্টারন্যাশনাল-বিপিআই নামের ছোট্ট সংবাদ সংস্থায় যোগ দিয়েছি জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। সেদিন ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২। ঘটনাচক্রে সেদিনই পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কাকতালীয়ভাবে আমার পেশাগত জীবনের প্রথম ‘রিপোর্টিং অ্যাসাইমেন্ট’ও ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের খবর সংগ্রহের কাজ দিয়ে।
মনে পড়ে, জাতির পিতা সর্বপ্রথম জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসেন ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই। সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকরা তাঁকে স্বাগত জানান। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। ক্লাবে ঢুকেই সাংবাদিক, কর্মচারীদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। কারও কারও সঙ্গে বুক মেলালেন। তিনি সেদিন অকপটে নতুন দেশের বাস্তবতা তুলে ধরেন। আমার ধারণা, সেদিনের ভাষণটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাস ও যুদ্ধ-পরবর্তীকালের সমাজ বাস্তবতা অনুধাবনে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে পারে। কারণ সদ্য স্বাধীন দেশের অনেক রূঢ় বাস্তবতা তিনি তুলে ধরেছিলেন সেদিন।
ভাষণটি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু এভাবে: ‘আপনারা জানেন, আমি আপনাদের আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আপনাদের অনেক সহকর্মী শুধু সাংবাদিক ছিলেন না; তাঁরা আমার ব্যক্তিগত বন্ধুও ছিলেন। আমি অনেক দিন তাঁদের সঙ্গে জেলখানায় কাটিয়েছি। এবারের সংগ্রামে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা আজ আমাদের মধ্যে নাই। তেমনি নাই ৩০ লক্ষ লোক, যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। তাঁদের কথা চিরদিন আমাদেরকে স্মরণ রাখতে হবে এবং যে আদর্শের জন্য তাঁরা জীবন দিয়েছেন, সে আদর্শে যদি বাংলাদেশ গড়ে তোলা যায়, তাহলে তাঁদের আত্মা শান্তি পাবে।’
তিনি বলেন: ‘সাংবাদিক ভাইদের কাছে আমার কয়েকটা স্পষ্ট আরজ আছে। আপনারা জানেন, বিপ্লবের মাধ্যমে এই স্বাধীনতা এসেছে এবং সে বিপ্লব ছিল রক্তক্ষয়ী। এমন বিপ্লবের পরে কোনো দেশ কোনো যুগে এতটা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে নাই, যা আমরা করছি। আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। আমরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতায়ও বিশ্বাস করি। এ জন্য আপনাদের কোনো কাজে কখনও কোনো রকম হস্তক্ষেপ করি নাই। যদিও নূতন বাংলাদেশ, ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশ।’
দেশ স্বাধীনের মাত্র কয়েক মাসের মাথায় সাংবাদিকতার নীতি ও নৈতিকতা সম্পর্কে জাতির পিতা বলেন: ‘গণতন্ত্রের অর্থ পরের ধন চুরি, খুন-জখম, লুঠতরাজ বা পরের অধিকার হরণ করা নয়। তার জনকল্যাণমূলক একটা নীতিমালা আছে। সাংবাদিকতারও এমনি একটা নীতিমালা আছে। আমরা জানি, সাংবাদিকদের মধ্যে এমন কেউ কেউ আছেন, যাঁরা সামরিক চক্রের হীন কাজে সহায়তা করেছেন। ...এই তথাকথিত সাংবাদিকদের একজন কোনো দৈনিক কাগজে সহকারী সম্পাদক হিসাবে কাজ করতেন। তিনি আলবদরের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন।