নদী প্রকৃতির এক অনন্য দান। সৃষ্টির সেই আদি থেকেই সে মানব জাতির পরম বন্ধু হিসেবে কাজ করছে। জীব হিসেবে মানুষের যে শ্রেষ্ঠত্ব, যত সৃষ্টি ও অর্জন, তার সবকিছুর সঙ্গে নদীর সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে। মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে নদীর অবদান অনস্বীকার্য। মানুষ নিজের কাজে নদীকে ইতিবাচকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে। সে জন্য মানুষকে নদীর মেজাজ ও প্রকৃতি বুঝতে হয়েছে; বুঝতে হয়েছে নদীর ভাষা। মানুষ নদীর ভাষাকে পাঠ করতে শিখে তবেই তাকে নিজের কাজে ব্যবহার করেছে। নদীর ভাষা বুঝতে অক্ষম হলে মানুষ কোনোদিনই তাকে নিজের মতো ব্যবহার করতে পারত না। মানুষ ও নদীর মিথস্ট্ক্রিয়া চিরকালের, আজন্মের। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, নদীর ভাষাকে বুঝতে পারা মানুষের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোনা। শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত মানুষ ভাষাকে নিজের মতো সংজ্ঞায়িত করেছে।
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র মতে, 'মনুষ্যজাতি যে ধ্বনি বা ধ্বনিসকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তার নাম ভাষা।' সব বিজ্ঞানীর সংজ্ঞার সারকথা হচ্ছে, মানুষ মনের ভাব প্রকাশের জন্য কণ্ঠনিঃসৃত বা মুখ থেকে বেরিয়ে আসা অর্থপূর্ণ আওয়াজ বা ধ্বনির সমষ্টি, তাকে ভাষা বলা হয়। স্পষ্টত যে শুধু মানুষের ভাষাই ভাষার মানদণ্ডে বিবেচিত হয়েছে; বাকি সবার ভাষা তেমন বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। মানব নির্মিত সংজ্ঞায় 'নদীর ভাষা' স্বতন্ত্র কোনো ভাষা হিসেবে স্বীকৃত নয়। শুধু নদী কেন; সৃষ্টিজগতের অন্য কারও ভাষার স্বীকৃতি মানব চিহ্নিত ভাষার আওতায় পড়ে না। তাই বলে সত্যিই কি তাদের পরস্পর যোগাযোগের কোনো ভাষা নেই?
মানুষের মতো নদীর কথা আছে; আছে ব্যথা। তারও আছে সুখ-দুঃখের অনুভূতি। আনন্দে সে উল্লসিত হয়; কষ্টে হয় মর্মাহত। কখনওবা সে অতিষ্ঠ হয়ে রুদ্র রূপ ধারণ করে। হয়ে ওঠে সর্বনাশা, প্রতিশোধপরায়ণ। আর নদীর সে আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, তর্জন-গর্জনের সব কথা সব মানুষের কাছে বোধগম্য হয়ে ওঠে না। নদীর সঙ্গে যাদের জীবনের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তারা খানিকটা নদীর সে ভাষা বুঝতে পারে। নদীর শান্ত রূপ থেকে তাই তারা নিজেদের প্রশান্তি খুঁজে পায়। নদী থেকে তারা নিজেদের যাপিত জীবনের চাহিদা পূরণ করে। নদীর ভাব বুঝে নদীকে তবেই তারা নিজেদের প্রয়োজনে কাজে লাগায়। নদীও তাদের কার্পণ্য করে না। আপনার সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে উপকার করে। নদীর ভাষা বোঝার জন্য প্রয়োজন নদীর সঙ্গে হৃদ্যপূর্ণ সম্পর্ক। সে সম্পর্ক না থাকলে নদীর ভাষা বোঝার ক্ষমতা কেউ কখনও অর্জন করতে পারে না।
নদীতীরের মানুষ কীভাবে নদীর ভাষা বুঝতে পারে- একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি পরিস্কার হবে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের খোলপেটুয়া নদীতীরের মানুষের কাছে 'চাঁদের হিসাবই নদীর ভাষা'। নদীতে দিনের গণনা চলে গুণের হিসাবে। ১৫ দিনে এক গুণ। এই গুণ হিসাব করেই জীবিকা চলে খোলপেটুয়া নদীতীরের মানুষের। সঙ্গে আকাশের চাঁদ আর বাতাসের গতিবিধির হিসাব বলে দেয় নদীর প্রকৃতি। বনের ভেতরে কিংবা সাগরের কাছাকাছি নদীতে থাকার সময় কোস্টগার্ড বা নৌ পুলিশের কাছ থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস মেলে না সবসময়। তখন প্রাকৃতিক এসব নিয়মই তাদের জানান দেয় নদীর কথা। সে হিসেবেই তরী ভাসায় জেলেরা।