বাংলাদেশ ঘাটতি-উদ্বৃত্ত সমস্যায় ভুগছে। কথাটি স্ববিরোধী মনে হলেও সত্যবর্জিত নয়। সর্বনিম্ন থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত এই উক্তিটি প্রযোজ্য। যেমন—দেশে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই।
আনাড়িরা এই কাজ নিজেদের মতো করে থাকেন। ফলে একদিকে যেমন রোগজীবাণু ছড়ায়, অন্যদিকে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কৌশল জানেন না। তাই কোনো ধরনের ব্যবস্থা ছাড়াই এই কাজ করেন। ফলে অল্প বয়সেই নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। যদি মধ্য পর্যায়ের জনগণের কথা চিন্তা করি, তাহলে দেখব যে আমাদের বিরাট গার্মেন্ট সেক্টরে মধ্য পর্যায়ের টেকনিশিয়ানের অভাব। ফলে পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে টেকনিশিয়ানরা এসে কাজ করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছেন। উচ্চ পর্যায়ের জনবলের অভাব আরো প্রকট। গ্যাস, বিদ্যুৎ, ওষুধশিল্পসহ অন্যান্য বড় বড় শিল্প-কারখানায় উচ্চ প্রযুক্তিগত দক্ষতাসম্পন্ন লোকবল নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রয়েছে ঘাটতি সমস্যা। এখানে উল্লেখ্য, বাধ্যতামূলক মৌলিক শিক্ষা শেষে স্বল্পমেয়াদি বৃত্তিমূলক শিক্ষা নিয়ে যদি কৃষি, হাঁস-মুরগি বা মাছের খামার চালাত তাতে উৎপাদন বহু বৃদ্ধি পেত। ফলে আর্থিকভাবে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র উপকৃত হতো।
এখন উদ্বৃত্ত সমস্যার দিকে নজর দেওয়া যাক। আমাদের শিক্ষাক্ষেত্র থেকে যাঁরা ডিগ্রি নিয়ে বের হচ্ছেন তাঁদের বেশির ভাগই উদ্বৃত্ত। শিক্ষার্থী এবং তাঁদের অভিভবক সবাই চান স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। ফলে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে দেড় শ বিশ্ববিদ্যালয়েও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। দেশে চাকরিসহ বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে সাধারণ ডিগ্রিধারী যতসংখ্যক লোকবল দরকার তার চেয়ে অনেক বেশি ডিগ্রিধারী প্রতিবছর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হচ্ছেন। অনেকে আবার সার্টিফিকেটধারী, কিন্তু মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত নন। ফলে সৃষ্টি হয়েই চলছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। এটাই হচ্ছে উদ্বৃত্ত সমস্যা। এতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্তই হচ্ছে না; বাড়ছে সন্ত্রাস, হানাহানি, রাহাজানি, নৈরাজ্য ও উচ্ছৃঙ্খলা। অনেক মধ্যবিত্ত পরিবার সহায়-সম্পদ, জায়গা-জমি বিক্রি করে সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে সর্বস্বান্ত হচ্ছে। নিম্নমানের শিক্ষায় শিক্ষিত সন্তানরা না পাচ্ছেন চাকরি, লোকলজ্জায় না করছেন দৈহিক পরিশ্রমের কাজ। তাঁরা জনসম্পদ নন, বরং বোঝা। এর জন্য দায়ী ব্যক্তি, অভিভাবক ও সমাজ নয়, দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যুগোপয়োগী শিক্ষানীতি। যেহেতু শিক্ষানীতি, স্বাস্থ্যনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতি পরস্পর পরিপূরক, প্রতিটি অন্যগুলোর ওপর নির্ভরশীল এবং প্রতিটি অন্যগুলোকে প্রভাবিত করে, তাই সবই যুগোপযোগী করা প্রয়োজন।