প্রস্তাবিত প্রকল্পের কাজ এগিয়ে যাচ্ছে জেনে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের ভেতর খুশির জোয়ার বইছে। তাদের এখন একটিই চাওয়া, যে করেই হোক বাধা পেরিয়ে এই প্রকল্প যেন বাস্তবায়িত হয়। তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হবে বলে অনেক দিন ধরেই এই অঞ্চলের মানুষ আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষা করছে।
ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি এক দশকের বেশি সময় ধরে সম্পন্ন করা যায়নি। এ রকম পরিস্থিতিতে এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে চীন বাংলাদেশের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। প্রায় দুই বছর ধরে চীনের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রকল্পের কথা শোনা গেলেও রহস্যজনক কারণে তা বাস্তবায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে বলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন। ৯ অক্টোবর ঢাকার চীনা রাষ্ট্রদূতের তিস্তা অববাহিকা পরিদর্শন এবং সেখানে প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিনিয়োগের কথা জানানোর পর তিস্তাপারের মানুষের মনেও আশার সঞ্চার হয়েছে। চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিংসহ তিন সদস্যের উচ্চপর্যায়ের একটি দল তিস্তা ব্যারাজ এলাকা এবং সেচ প্রকল্পসহ পুরো এলাকা ঘুরে দেখে। পরিদর্শন শেষে লি জিমিং বলেন, ‘স্থানীয় জনগণের চাহিদা এবং কিসে তাদের ভালো হবে, তা চীনের কাছে অগ্রাধিকার পাবে। তিস্তা একটি বড় নদী; এটি খনন করতে পারলে এই অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের ব্যাপক পরিবর্তন হবে। অর্থনীতি, যোগাযোগব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। যদিও এই প্রকল্প বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে, তারপরও আমরা এটি করব।’
আবহাওয়া, প্রকৃতি-পরিবেশ সবই এই মহাপরিকল্পনার অনুকূলে আছে বলে রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন। এটির বাস্তবায়নে ঢাকা-বেইজিংয়ের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় ও গভীর আলোচনা চলছে বলেও তিনি জানান। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন চীনের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন এবং ভারতের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘তিস্তা নিয়ে আমরা ১২ বছর ধরে দেনদরবার করে আসছি, সেখানে গৃহীত প্রকল্পে চীন যদি বিনিয়োগ করে, তাতে বাংলাদেশের আপত্তি নেই।’ তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হওয়ার পরও ২০১১ সাল থেকে এটি ঝুলে আছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চুক্তি স্বাক্ষরের পক্ষে তাদের মনোভাব প্রকাশ করলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে এত দিন ধরে এটি ঝুলে আছে। তবে যে কারণেই তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি আটকে থাকুক না কেন, তিস্তা নদীর ভাঙন ও বন্যা কিন্তু থেমে নেই। নদীভাঙনে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ গৃহহারা হচ্ছে। বিলীন হচ্ছে হেক্টরের পর হেক্টর ফসলি জমি। ভারতের গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণের পর প্রতিবছর প্রবল বন্যার সময় ব্যারাজের সব জলকপাট যখন খুলে দেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বন্যায় ভেসে যায়। বছরে অন্তত দুই থেকে তিনবার রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার তিস্তাতীরবর্তী অঞ্চলে এরূপ সর্বনাশা বন্যা নেমে আসে। আবার শুষ্ক মৌসুমে গজলডোবা ব্যারাজের জলকপাটগুলো বন্ধ করে পানির প্রবাহ আটকে দিলে, পানির অভাবে কৃষকের চাষের জমি রোদে পুড়ে খাঁ খাঁ হয়ে যায়। দুঃখজনক হলো, সিকিম রাজ্যের সীমানায় তিস্তা নদীতে বেশ কয়েকটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ব্যারাজ নির্মাণের কারণে এমনিতেই গজলডোবা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে গেছে। একই সঙ্গে যে পরিমাণ পানি সেখানে আসে, ওই ব্যারাজের মাধ্যমে যদি সেটুকুও প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তাহলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে পানির প্রবাহ একেবারেই শূন্যে নেমে আসে।