যুগান্তর : দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রাখতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এখন প্রয়োজন বিভেদ ভুলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় ঐক্য গড়ে দেশকে এগিয়ে নেয়া। টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর শুক্রবার প্রথমবার জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। ভাষণের শুরুতেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটকে বিপুলভাবে বিজয়ী করায় দেশবাসীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি উচ্ছেদে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, দুর্নীতি নিয়ে সমাজের সর্বস্তরে অস্বস্তি রয়েছে। আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি উচ্ছেদ করা হবে। এরই মধ্যে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার সম্প্রসারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দুর্নীতি নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরিতে গণমাধ্যমের সহায়তা নেয়ার কাজ অব্যাহত থাকবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শোধরানোর আহ্বান জানান তিনি।শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণ টেলিভিশন ও বেতারসহ গণমাধ্যমে একযোগে সম্প্রচার করা হয়। ভাষণে তিনি মহাজোটের ভূমিধস বিজয়ের (ল্যান্ড স্লাইড ভিকটরি) নেপথ্য ১৪টি কারণ উল্লেখ করেন। পাশাপাশি বিএনপি জোটের পরাজয়ের বেশ কয়েকটি কারণও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বিএনপির ধানের শীষ মার্কায় যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাদের মনোনয়ন তরুণ ভোটাররা মেনে নিতে পারেনি। তরুণরা আর যা-ই হোক, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষ নিতে পারে না। তিনি বলেন, একাদশ সংসদে বিরোধী দলের সদস্যসংখ্যা নিতান্তই কম। তবে সংখ্যা দিয়ে আমরা তাদের বিবেচনা করব না। সংখ্যা যত কমই হোক, সংসদে যে কোনো সদস্যের ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রস্তাব, আলোচনা-সমালোচনার যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে। তিনি বিরোধী দলের নির্বাচিত সদস্যদের শপথ নিয়ে সংসদে যোগদানের আহ্বান জানান। এ সময় তিনি দেশের উন্নয়নে নেয়া প্রকল্প ও পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন।প্রধানমন্ত্রী জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বলেন, এখন আমাদের প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য। বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের ঐক্যের যোগসূত্র হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অসাম্প্রদায়িকতা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সাম্য ও ন্যায়বিচার এবং উন্নয়ন ও অগ্রগতি। বিজয়ের পর আমরা সরকার গঠন করেছি। সরকারের দৃষ্টিতে দলমত নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিক সমান। আমরা সবার জন্য কাজ করব। সরকারি সেবা খাতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং জাতীয় জীবনের সর্বত্র আইনের শাসন সমুন্নত রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করব। জাতীয় সংসদ হবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণের কেন্দ্রবিন্দু।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ কথামালার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। আমরা যে প্রতিশ্রুতি দেই তা বাস্তবায়ন করি। ২০০৮ এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছিলাম, তার অধিকাংশই ইতিমধ্যে বাস্তবায়ন করেছি। তিনি বলেন, আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব শিক্ষিত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা। তরুণদের কর্মসংস্থানের জন্য আমরা বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা প্রদানসহ বিভিন্ন সুবিধা নিশ্চিত করা। তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা ও প্রণোদনা প্রদান। সরকারি উদ্যোগে কর্মসংস্থান পরিকল্পনা, তরুণ উদ্ভাবকদের উদ্ভাবনসমূহ আন্তর্জাতিকভাবে পেটেন্ট করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। দেশ-বিদেশে কর্মে নিয়োগের জন্য কারিগরি বিষয়ে দক্ষ কর্মী তৈরি এবং কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ জনবল গড়ে তোলার জন্য প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কারিগরি কলেজ স্থাপন করা। ইতিমধ্যে কারিগরি কলেজ স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে।এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, তরুণেরাই দেশের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। তারুণ্যের সৃষ্টিশীলতা, উদ্যম এবং শক্তির ওপর আমাদের পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আস্থা রয়েছে। তিনি তরুণদের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে বলেন, আগামী পাঁচ বছরে আমরা দেড় কোটি কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলেছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগের জন্য আসছেন।প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে বলেন, সারা দেশে দুই ডজনের বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলছে। কৃষি, মৎস্য, পশুপালন, পর্যটন, সেবা খাতসহ বিভিন্ন খাতে প্রাতিষ্ঠানিক এবং আত্ম-কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। আমরা চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছি। বিশেষ করে পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেষখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত উন্নয়ন প্রকল্পসহ ফাস্ট ট্র্যাক মেগা প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাজে গতি আনা হবে।শেখ হাসিনা বলেন, ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা ২০২০-২০২১ সালে মুজিব বর্ষ এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করব। বাঙালি জাতির এ দুই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা দেশকে আর্থ-সামাজিক খাতে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে চাই। আর এর কৌশল হিসেবে আমরা ভিশন-২০২১ এবং ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়ন করছি। পাশাপাশি, জলবায়ুর ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন অর্জনের জন্য আমরা ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ নামে শতবর্ষের একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। আমরা ইতিমধ্যে সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো সম্পৃক্ত করে তা বাস্তবায়ন শুরু করেছি। অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজও শুরু হয়েছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- আমাদের এ পররাষ্ট্র নীতিই বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের মূল হাতিয়ার। এ নীতির সফল বাস্তবায়ন বাংলাদেশকে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক যে কোনো সময়ের চাইতে সুদৃঢ় এবং গভীর।তিনি বলেন, আমরা একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেখানে হিংসা-বিদ্বেষ হানাহানি থাকবে না। সব ধর্ম-বর্ণ এবং সম্প্রদায়ের মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবেন। সবাই নিজ নিজ ধর্ম যথাযথ মর্যাদার সঙ্গে পালন করতে পারবেন। বৈশ্বিক প্রভাবে কিংবা স্থানীয় প্ররোচনায় আমরা কিছু কিছু তরুণকে বিভ্রান্তির শিকার হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত হতে দেখেছি। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলামে সন্ত্রাসের কোনো স্থান নেই। আমি সমাজের সবাইকে মাদকাসক্তি ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছি। তিনি বলেন, ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারে আমরা কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছি। মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের মাধ্যমে উৎপাদনমুখী করা হচ্ছে। কওমি মাদ্রাসার দাওয়ারে হাদিস ডিগ্রিকে মাস্টার্স ডিগ্রির সমমান করা হয়েছে। সারা দেশে ৫৬০টি মসজিদ কাম-ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে।প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় ছিল খুবই প্রত্যাশিত। নির্বাচনের আগে দেশি-বিদেশি জরিপগুলোও এ রকমই ফলাফলের ইঙ্গিত দিয়েছিল। অপরদিকে সাধারণ ভোটাররা বিএনপির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন এবং নৌকার অনুকূলে এবার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল।তিনি জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, আপনারা টানা তৃতীয়বার এবং ১৯৯৬ সাল থেকে চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে সরকার পরিচালনার ম্যান্ডেট দিয়েছেন। আপনাদের এবারের এ নিরঙ্কুশ সমর্থন আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাদের এ রায়কে দেশবাসীর সেবা এবং জাতির পিতার অসমাপ্ত কাজ শেষ করার ও সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার পথে আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, আপনারা আমার ওপর আস্থা রেখে যে রায় দিয়েছেন, কথা দিচ্ছি আমি প্রাণপণ চেষ্টা করব সে আস্থার প্রতিদান দিতে। এ জন্যদলমত নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের সমর্থন এবং সহযোগিতা চাই।প্রধানমন্ত্রী বলেন, নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে আমি আমার মন্ত্রিসভা গঠন করেছি। প্রবীণদের অভিজ্ঞতা আর নবীনদের উদ্যম- এই দুইয়ের সমন্বয়ে আমরা আমাদের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঘোষিত ইশতেহার দেশগঠনে আগামীর পথনির্দেশক হবে। তিনি ২০০৮ সালের আগের বাংলাদেশের প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, দশ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। মানুষের জীবনমান এখন অনেক উন্নত। এখন মানুষ সুন্দর করে বাঁচার স্বপ্ন দেখে। দেশকে আমরা আরও উন্নত করতে চাই। তাই সামনে অনেক কাজ আমাদের। আরও কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই বন্ধুর পথ অতিক্রম করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধা পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। প্রতিটি ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে। ছেলেমেয়েদের উন্নত পরিবেশে লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি করা হবে। সুপেয় পানি এবং উন্নতমানের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। সুস্থ বিনোদন এবং খেলাধুলার জন্য অবকাঠামো গড়ে তোলা হবে। ইন্টারনেট-তথ্যপ্রযুক্তি সর্বত্র পৌঁছে যাবে।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, আমার ব্যক্তিগত কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। বাবা-মা-ভাই, আত্মীয়-পরিজনকে হারিয়ে আমি রাজনীতি করছি শুধু জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য; এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। এ দেশের সাধারণ মানুষেরা যাতে ভালোভাবে বাঁচতে পারে, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবনের অধিকারী হতে পারে, তা বাস্তবায়ন করাই আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।প্রধানমন্ত্রী মহাজোটের বিপুল বিজয়ের জন্য ভাষণের শুরুতে মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শোকরিয়া আদায় করে বলেন, যারা নৌকায় ভোট দিয়ে আমাদের বিজয়ী করেছেন আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। যারা আমাদের ভোট দেননি, আমি তাদেরও ধন্যবাদ জানাচ্ছি নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য। নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দল ও জোট এবং প্রার্থীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি পাশাপাশি আওয়ামী লীগের সব নেতাকর্মী, সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, সবার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সহযোগিতায় আমরা এ বিশাল বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। ভাষণে প্রধানমন্ত্রী সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করায় দেশবাসী, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সব সদস্যের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানান।প্রধানমন্ত্রী প্রসঙ্গক্রমে বিএনপি জোটের নির্বাচনে ভালো না করার কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। এর মধ্যে আছে- এক আসনে ৩-৪ জন বা তারও বেশি প্রার্থী মনোনয়ন; মনোনয়ন নিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যের অভিযোগ এবং দুর্বল প্রার্থী মনোনয়ন; নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠাতা পেলে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা; নিজেরা জনগণের জন্য কী করবে, সে কথা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছে। অপরদিকে ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কী ধরনের প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা নেবে- তাদের প্রচারণায় প্রাধান্য পেয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা ছাড়া নিজেদের সাফল্যগাথা তুলে ধরতে পারেনি। তাছাড়া, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াতের দেশব্যাপী অগ্নিসন্ত্রাস ও ধ্বংসাÍক কর্মকাণ্ড সাধারণ মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ বিস্তার, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়নসহ আর্থসামাজিক নানা সূচকে বাংলাদেশ বিগত দশ বছরে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। শুধু এশিয়ার দেশগুলোরই শীর্ষে নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন অনেক উন্নত দেশকেও ছাড়িয়ে গেছে। বিশ্ব নেতারা তাই বাংলাদেশকে চেনেন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’ হিসেবে। তবে আমাদের এই পথচলা মসৃণ ছিল না। শত প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছি। যার সুফল আজ জনগণ পাচ্ছেন। এ অর্জন শুধু সরকারের নয়, এ অর্জন দেশের প্রতিটি পরিশ্রমী মানুষের।তিনি আরও বলেন, আজ বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে। বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২১.৮ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে যা ২০০৫-০৬ সালে বিএনপি সরকারের আমলে ছিল ৪১.৫ শতাংশ। মাথাপিছু আয় ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে ১ হাজার ৭৫১ ডলারে উন্নীত হয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ বিলিয়ন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিএনপি সরকারের ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৬১ হাজার কোটি টাকা। যা ৭.৬ গুণ বৃদ্ধি করে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমরা ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট দিয়েছি। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির পরিমাণ ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা। যার নব্বই ভাগ বাস্তবায়ন হয় নিজস্ব অর্থায়নে। কারও কাছে আমাদের হাত পেতে চলতে হয় না। গত অর্থবছরে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭.৮৬ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি ৫.৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় রয়েছে।প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শহীদ ও বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করেন। একইভাবে স্মরণ করেন জাতীয় চার নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনের অবদান। মুক্তিযোদ্ধাদের সালাম জানান। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ও গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। স্মরণ করেন সদ্য প্রয়াত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দু’বারের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এবং জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ দশম সংসদের প্রয়াত সদস্যদের। গভীর শ্রদ্ধা জানান বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য অকাতরে জীবন দেয়া ভাষা শহীদদের প্রতি। তিনি ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় নিহত আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২২ নেতাকর্মী, ২০০১ সালের পর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা আহসানউল্লাহ মাস্টার, মঞ্জুরুল ইমাম, মমতাজউদ্দিনসহ ২১ হাজার নেতাকর্মী, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোটের অগ্নিসন্ত্রাস এবং পেট্রলবোমা হামলায় এবং সর্বশেষ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের হামলায় নিহত ২৪ জনকে স্মরণ ও তাদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন।