প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গ্রামে থাকিতে ইচ্ছুক নহেন বলিয়া বুধবার সমকালে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় বলিয়া আমরা মনে করি। তিন বৎসর পর গত মাসে সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বদলির জন্য অনলাইনে আবেদনের সুযোগ দিয়াছিল। এই মাসের প্রথম সপ্তাহে আবেদনের সময় শেষ হইবার পর দেখা যাইতেছে, প্রায় ২৬ সহস্র শিক্ষক আবেদন করিয়াছেন। তবে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে অনলাইনে আবেদন শুরু হইবার পর হইতেই শিক্ষকগণ অভিযোগ করিয়া আসিতেছিলেন, প্রযুক্তিগত জটিলতা ছাড়াও বদলি নীতিমালায় কঠিন শর্ত সংযুক্ত করিবার কারণে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক আবেদন করিতে পারেন নাই। অর্থাৎ শহরমুখী শিক্ষকের স্রোত বাস্তবে আরও দীর্ঘ হইবার কথা। উল্লেখ্য, সিটি করপোরেশনের বাহির হইতে ঢাকাসহ দেশের সিটি করপোরেশন এলাকাসমূহে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা রাখা হয় নাই।
যাঁহারা বদলির আবেদন করিতে পারিয়াছিলেন, স্বাভাবিকভাবেই তাঁহাদের অধিকাংশের ঝোঁক শহরাঞ্চলের দিকে। বস্তুত বদলির সুযোগ পাইলেই তাঁহাদের পছন্দের অগ্রভাগে থাকে শহর এলাকা। কারণ শহরে বসবাসের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বিদ্যমান। পল্লি অঞ্চল অপেক্ষা শহর অঞ্চলে টিউশনির সুযোগ বেশি, যাহা অনেক শিক্ষকের নিকট বাড়তি আয়ের একটা মোক্ষম উপায়- তাহাও স্মরণে রাখিতে হইবে। ইহাও অস্বীকার করা যাইবে না, অনেকে স্থায়ী ঠিকানা এবং স্বামী বা স্ত্রীর কর্মস্থল শহরে হওয়ায় তথায় বদলি হইতে চাহেন। ইহা অসংগত কিছু নহে। কিন্তু যেই হারে অধিকাংশ প্রাথমিক শিক্ষক শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাইবার নিমিত্তে আবেদন করিয়াছেন, তাহা নিঃসন্দেহে ভালো লক্ষণ নহে। শিক্ষকতা অন্য আট-দশটা চাকরির মতো নহে। জীবিকা হইলেও ইহা এক প্রকার ব্রতও বটে। এই বছরের জনশুমারি ও গৃহগণনার প্রাথমিক ফলে আমরা দেখিয়াছি, এখনও ৬৮ শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করিতেছে। অনুসন্ধান করিলে দেখা যাইবে, এইসব মানুষের অনেকে বিভিন্ন কারণে শিক্ষার আলো হইতে বঞ্চিত। সেই কারণসমূহের মধ্যে যেমন আছে গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্তসংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতি, তেমনি যথেষ্ট সংখ্যক শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকের অভাব। আর মানসম্মত শিক্ষকের কথা বলিলে গ্রামসমূহ যে শহর হইতে যোজন যোজন পশ্চাতে অবস্থান করিতেছে, তাহা বলাই বাহুল্য। সুতরাং, যত সংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষক শহর অঞ্চলে বদলি হইতে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাদের সকলকে যদি এই সুযোগ দেওয়া হয় তাহা হইলে গ্রামসমূহ শিক্ষাক্ষেত্রে আরও পশ্চাতে থাকিবে। গত মাসের প্রথম সপ্তাহে সমকালের লোকালয়ে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের প্রাথমিক শিক্ষা লইয়া ধারাবাহিকভাবে যেই পাঁচটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হইয়াছিল, সেইখানে আমরা দেখিয়াছি, একটি বিদ্যালয়ে পাঁচজন শিক্ষকের পদ থাকিলেও তিনটিই শূন্য। কোথাও পাঁচজন শিক্ষকের স্থলে তিনজন রহিয়াছেন। এই পরিস্থিতির বেলায় শিক্ষক নিয়োগ কম হইবার প্রভাব যেমন রহিয়াছে, তেমনি শিক্ষকদের শহরমুখী হইবার প্রবণতাও কম দায়ী নহে।