গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বড়সড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশে পুঁজি পাচার। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর যা হওয়ার কথা, এর চেয়ে ১ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ কম হচ্ছে পুঁজি পাচার ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায়। এই ক্রমবর্ধমান পুঁজি পাচারের কারণে প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত ২৪ শতাংশের আশপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, যদিও সরকারি বিনিয়োগ-জিডিপির অনুপাত বেড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ায় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার তেমন কমছে না। সাম্প্রতিক সময়ে আমদানির লাগামহীন প্রবৃদ্ধি, বাণিজ্য ঘাটতির বিপজ্জনক স্ম্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ধস এবং ডলারের কার্ব মার্কেটে দামের উল্লম্ম্ফনের পেছনেও প্রধান কারণ বিদেশে পুঁজি পাচার বেড়ে যাওয়া। এই পুঁজি পাচারকারীরা জাতির 'এক নম্বর দুশমন'। তারা যদি ব্যাপক হারে বিদেশে পুঁজি পাচার না করত তাহলে অর্থনীতি বর্তমান সংকটে পড়ত না। সে জন্য শুধু সরকার নয়, দেশ-বিদেশে অবস্থানকারী সব বাংলাদেশির কর্তব্য এদের ঘৃণা, বয়কট এবং প্রতিহত করা।
অনেকেরই হয়তো জানা নেই, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলাকে উপনিবেশ করার আগে কয়েকশ বছর ধরে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচুর্যময় অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃত ছিল তদানীন্তন বাংলা। এই স্বীকৃতি প্রথম দিয়েছিলেন বিশ্বখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা, যিনি বাংলার সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের আমলে এ দেশে এসেছিলেন। দ্বিতীয় স্বীকৃতিটি এসেছিল মোগল সম্রাট আকবরের 'নবরত্ন' সভার খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের লিখিত ইতিহাসে। তাঁর রচিত আকবরনামায় তিনি স্বীকার করেছেন, সম্রাট আকবরের শাসনাধীন ভারতবর্ষে সবচেয়ে প্রাচুর্যময় প্রদেশ ছিল 'সুবা বাংলা'। তৃতীয় স্বীকৃতি দিয়েছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরাসি 'কোর্ট ডাক্তার' ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ার। বার্নিয়ারের মতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে বিশ্বে সবচেয়ে প্রাচুর্যময় অঞ্চল হিসেবে মিসরের যে সুনাম ছিল, সে সুনামের প্রকৃত দাবিদার ছিল বাংলা। কিছুদিনের মধ্যেই আরেক ফরাসি ব্যবসায়ী ট্যাভারনিয়ার বার্নিয়ারকে এ বিষয়ে সমর্থন জানিয়েছিলেন। ট্যাভারনিয়ার চামড়ার ব্যবসার জন্য বেশ কয়েকবার বাংলায় আসার কারণে এই অঞ্চল সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। কার্ল মার্কস বার্নিয়ারের এই স্বীকৃতির উদ্ধৃতি দেওয়ায় বিশ্বে তা বহুলপরিচিতি অর্জন করেছে। ১৭৫৭ সালে বাংলা দখল করার পর ১০০ বছর ধরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা-কর্মচারী, সিপাহসালার ও সিপাহিরা জাহাজের পর জাহাজ বোঝাই করে বাংলা থেকে ধনসম্পদ ও সোনা-রুপা লুণ্ঠন করে ইংল্যান্ডে নিয়ে গেছে। তাদের এই পুঁজি পাচারের পরিমাণ এতই বেশি ছিল যে, লুণ্ঠিত সামগ্রীবাহী জাহাজগুলো লন্ডন বন্দরে খালাস করার সময় তিন মাসের একটি জাহাজ-জট সৃষ্টি হয়েছিল বলে প্রমাণ করেছেন ব্রুক অ্যাডামস নামে এক মার্কিন ইতিহাসবিদ। আরও অনেক ঐতিহাসিকের গবেষণার মাধ্যমে এই বাংলা লুণ্ঠনের কাহিনি প্রমাণিত হওয়ার ফলে এখন ইতিহাসে এই লুণ্ঠন পর্বকে 'দ্য বেঙ্গল লুট' নামে অভিহিত করা হচ্ছে। ১৯৪৭ সালে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার নামে আবার ২৪ বছরের জন্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশে পরিণত হওয়ায় আরেক দফা লুণ্ঠন, বঞ্চনা ও পুঁজি পাচারের শিকার হয়েছিল তদানীন্তন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান। বর্তমান সময়ের পুঁজি পাচারকারীদের আমি 'জাতির এক নম্বর দুশমন' বলছি। তাদের আমি লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও পাঞ্জাবি-পাকিস্তানিদের 'ভাবাদর্শিক দোসর' মনে করি। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে আগাগোড়াই প্রধান বাধা দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সাল থেকে দুর্নীতি ক্রমেই বিস্তার লাভ করলেও বঙ্গবন্ধুর শাসনকালে দুর্নীতি ছিল ব্যতিক্রমী আচরণ; রাজনীতি ও আমলাতন্ত্রে তখনও ওটা নিয়মে পরিণত হয়নি। কিন্তু সমরপ্রভু জিয়া নিজেকে সততার পরাকাষ্ঠা হিসেবে জাহির করলেও তাঁর শাসনামল থেকে দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠন বাড়তে শুরু করে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি স্বৈরাচার এরশাদ আমলে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। ১৯৯১ সালে ভোটের রাজনীতি চালু হওয়ার পর গত ৩১ বছর একই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হয়েছে।