মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের স্তর বোঝানোর চেষ্টা ও এর অনর্গল প্রচারণায় মানুষ এখন মহাবিরক্ত। অবশ্য বাংলাদেশে এই বিরক্তিকর প্রচারণা শুরু হওয়ার বহু আগেই বিশ্বের অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষক ও অন্যান্য পেশাজীবীরা উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে এ ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং সেই প্রত্যাখ্যান শুধু যে সাম্যবাদী চিন্তাবিদদের পক্ষ থেকেই হয়েছে তা-ই নয়, খোদ পুঁজিবাদী আদর্শে বিশ্বাসী অর্থনীতিবিদেরাও মাথাপিছু আয় দিয়ে উন্নয়নের স্তর নির্ধারণের ধারণাকে ভ্রান্তিপূর্ণ বলে মনে করেছেন। আর এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সাল থেকে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) উন্নয়নের পরিমাপক হিসেবে মানব উন্নয়ন সূচকের (হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটর—এইচডিআই) প্রবর্তন করে, যে ধারণার মূল উদ্ভাবক হচ্ছেন পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদ মাহবুবুল হক।
উল্লিখিত এইচডিআইয়ের আওতাধীন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সূচকগুলোর অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা, যা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সর্বজনস্বীকৃত পাঁচটি অত্যাবশ্যকীয় মৌলিক চাহিদারই অংশ। কিন্তু অতিদুর্বল স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও চরম মানহীন জরাজীর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার দিকে মনোযোগ না দিয়ে রাষ্ট্র কেবলই প্রচারণা চালাচ্ছে গুরুত্বহীন মাথাপিছু আয় নিয়ে, যার সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের স্বার্থের কোনোই সম্পর্ক নেই। এতে মানুষ যে শুধু বিরক্তই হচ্ছে তা-ই নয়, সরকারের চিন্তার অগ্রগামিতা ও গণমুখীনতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে।
তদুপরি এরূপ ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণাকে উন্নয়নের সূচক হিসেবে রাজনৈতিকভাবে প্রচার করতে গিয়ে বস্তুত এটিকে তাঁরা রাষ্ট্রের নীতি হিসেবেও গ্রহণ করে ফেলছেন, যার ফলে রাষ্ট্রের উন্নয়ন-কৌশল ও কর্মসূচিতে জনস্বার্থের বিষয়টি ক্রমেই উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে এবং এর বিপরীতে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিত্তবানের স্বার্থরক্ষার বিষয়টি। আর শেষোক্ত ওই কাজটি শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদ থেকে ঘটলেও প্রকারান্তরে তার পেছনে রয়েছে ক্ষমতা সুরক্ষার আকাঙ্ক্ষাও। কিন্তু রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকেরা সম্ভবত ভুলে যাচ্ছেন যে রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোর সুবিধা নিয়ে কার্যহাসিলের পর ক্ষমতা সুরক্ষার বাস্তব প্রয়োজনের সময় ওই চতুর বিত্তবানদের আর কাউকেই কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না, অতীতেও পাওয়া যায়নি।