ভারতজুড়ে এখন এক লঙ্কাকাণ্ড চলছে।
দুর্নীতির ইস্যুতে ভারতীয় আয়কর দপ্তর, এনফোর্সমেন্ট বিভাগ আর সিবিআই রাজ্যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে নেমে পড়েছে। ১৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বক্তৃতাতেই বলেছিলেন যে আমরা এখন দুর্নীতি মোকাবেলায় এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁকের মুখে এসে দাঁড়িয়েছি। অর্থাৎ একটা নতুন অধ্যায় কার্যত শুরু হতে চলেছে। তখনো সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনি এই ঘোষণার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য কতখানি?
পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০২১ সালে বিজেপির গগনচুম্বী প্রত্যাশায় জল ঢেলে দিয়ে তারা আবার ক্ষমতায় এসেছে। যদিও বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের প্রধান বিরোধী দল হয়ে উঠেছে, যা কিছুদিন আগে পর্যন্ত ছিল না। কার্যত বিজেপির অস্তিত্বই ছিল না পশ্চিমবঙ্গে। কংগ্রেস, সিপিএম—যে দুই বিরোধী দল পশ্চিমবঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ পরিসর নিয়েছিল, এখন বিধানসভায় তাদের কোনো বিধায়ক নেই। আর এখন এক এক করে রাজ্যের তাবড় তাবড় তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে যেভাবে তদন্ত চলছে, নানা রকমের তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে, তাতে রাজ্যজুড়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে একটা সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
সাবেক শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এখন হাজতে। তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বলে পরিচিত অর্পিতার বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে কোটি কোটি টাকা। সেই সব দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষের গা ঘিন ঘিন করে উঠেছে। যেখানে মানুষ শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষায় পাস করেও চাকরি পাচ্ছে না, তারা ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছে একটা চাকরির জন্য, আর সেই সব গরিব মানুষের চোখের জলের টাকাই নাকি জমা পড়েছে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কোষাগারে। এমনটাই অভিযোগ তৃণমূলবিরোধী বিজেপির। এখনো তদন্ত চলছে। সুতরাং শেষ কথা এখনই বলার সময় আসেনি। কিন্তু তারই মধ্যে গরু পাচার চক্রের এক মহানায়ক বলে অভিযুক্ত অনুব্রত মণ্ডলও জেলে। তাঁর কন্যার বিরুদ্ধেও নানা রকমের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। কিভাবে তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক হলেন! এত বাড়ি, এত গাড়ি—সব মিলিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কিন্তু একটা রাজনৈতিক বিবেচনা সাংঘাতিকভাবে নেতিবাচক হয়ে উঠেছে। আর বিজেপি সেটাকে মূল্যায়ন করে পশ্চিমবঙ্গে দ্রুত অগ্রসর হতে চাইছে দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে।
এই গেল পশ্চিমবঙ্গের কথা। কিন্তু সেই সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়ালের ডান হাত আম আদমি পার্টির নেতা অর্থমন্ত্রী মনীষ সিসোধিয়ার বিরুদ্ধেও এসেছে দুর্নীতির অভিযোগ। অবৈধ মদের ব্যবসার চক্রের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এবং আরো কত কী! যখন অরবিন্দ কেজরিওয়াল গুজরাটের আসন্ন নির্বাচনের আগে সেখানে গিয়ে ঘাঁটি গাড়ছেন, ‘আপ’ অর্থাৎ আম আদমি পার্টি যখন সেখানে সাফল্যের সম্ভাবনার কথা ভাবছিল। পাঞ্জাবে কংগ্রেসকে পরাস্ত করে দলটি ক্ষমতায় এসেছে। রাজস্থান, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশের আসন্ন নির্বাচনে কেজরিওয়াল এগোতে চাইছেন, আর ঠিক সেই সময় কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধেও এসে গেল সরকারি কশাঘাত। যেখানে বিজেপিবিরোধী যেসব দল ক্ষমতায় আছে, সেখানেই এই অভিযান হচ্ছে বলে অভিযোগ। এমনকি প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের প্রধান সোনিয়া গান্ধী এবং তাঁর পুত্র রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে। ন্যাশনাল হেরাল্ড নামের সনাতনি সংবাদপত্রের তহবিল গান্ধী পরিবার তছরুপ করেছে, এমন অভিযোগ করে মামলা করেছিলেন সুব্রামানিয়াম স্বামী নামের এক বিতর্কিত বিজেপি সংসদ সদস্য। আদালতের নির্দেশে তাই সেখানেও সিবিআই তদন্ত শুরু করে দিয়েছে।
এখন এই প্রবল দুর্নীতির অভিযানে বিরোধী নেতারা অভিযোগ করেছেন যে মোদি ও অমিত শাহর এটা একটা সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। সরকারি এজেন্সিকে কাজে লাগানো হচ্ছে বিরোধী শক্তিকে চাপে ফেলার জন্য। সাংগঠনিকভাবে মোকাবেলা না করে এজেন্সির সাহায্য নিয়ে এই কাজটি করা হচ্ছে। অনেকে বলছেন, গুজরাটে যখন নরেন্দ্র মোদি মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন বিজেপি ছিল বিরোধী দল। তখনো বিজেপি সিবিআইকে বলত সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন এবং কংগ্রেস একইভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে নানাভাবে ষড়যন্ত্র করেছিল। চিদাম্বরম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকার সময় অমিত শাহকে জেলও খাটতে হয়েছিল নানা অভিযোগের ভিত্তিতে; যদিও পরবর্তীকালে ক্ষমতায় আসার পর সুপ্রিম কোর্ট অমিত শাহকে এসব অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস করে দিয়েছেন। গোদরার দাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত নরেন্দ্র মোদিও আদালতে এই ছাড় পেয়েছেন। আজ তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী।
রাজনীতিতে পারস্পরিক দোষারোপ নতুন কিছু নয়। একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে সব সময়ই দোষ দিয়ে থাকে। কিন্তু বিরোধী শিবিরের চিত্রটা এর ফলে কী হয়ে উঠেছে? বিরোধী শিবির কি মোদি তথা বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ? সমবেতভাবে কি চিৎকার করে বলছে যে মোদি, অমিত শাহ আমাদের সবাইকে এজেন্সির মাধ্যমে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রমাণ করতে চাইছে আর এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? না, এটা কিন্তু বিরোধী শিবিরে দেখা যাচ্ছে না।