টাঙ্গাইলের দোকান সংস্কৃতি

সমকাল মামুনুর রশীদ প্রকাশিত: ২১ আগস্ট ২০২২, ০৯:২০

আমার বাড়ি টাঙ্গাইল হলেও জন্মেছি টাঙ্গাইল থেকে দশ কিলোমিটার দূরে, বলতে গেলে তখনকার এক অজপাড়া গাঁয়ে। জ্ঞান হওয়ার পর কখন টাঙ্গাইল শহরে এসেছি, তা আজ আর মনে পড়ে না। তবে টাঙ্গাইলই আমার প্রথম দেখা শহর, প্রিয় শহর। শহরময় সরু পাকা পথ এবং শহরের প্রধান পথটির সমান্তরালে একটি খাল। সারা বছর খালটায় পানি থাকত। গ্রাম থেকে লোকজন নৌকা করে যাওয়া-আসা করত। খালটি দীর্ঘদিন হলো বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। বড় একটা দালান ছিল ঘ্যাগের দালান। সেখানে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, 'আর চিন্তা নাই ঘ্যাগের ওষুধ পাওয়া গেছে'। দালানের দক্ষিণ দিকে কিছু দোকানপাট এবং রাস্তাটি চলে গেছে ছয়আনি বাজারের দিকে। এটাই ছিল তখন একমাত্র বাজার। সন্ধ্যার পর শহরটি নৈঃশব্দে ভরে যেত। রাস্তার দু'পাশে গন্ধরাজ, কামিনী ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসত। সেই সঙ্গে বাড়িগুলো থেকে হারমোনিয়ামের সঙ্গে গলা সাধার শব্দ পাওয়া যেত। ঘ্যাগের দালান থেকে একটু কাছেই প্রধান সড়কে ছিল করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাবের অফিস, অফিসসংলগ্ন মঞ্চ। মঞ্চটি ভাড়া দেওয়া হয়েছিল সিনেমা হলকে। সিনেমা হলের নাম কালি সিনেমা। এই ছিল পঞ্চাশের দশকের টাঙ্গাইল।


১৯৬৭ সালে টাঙ্গাইল জেলা হয়ে গেল। কলেবর বাড়তে থাকল চারদিকে। নতুন জেলা সদর নির্মিত হলো। শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে একটু দূরে, সেইসঙ্গে দোকানপাট বাড়ারও প্রয়োজন দেখা দিল। এর মধ্যেই গড়ে উঠল টাঙ্গাইলের নিউমার্কেট। একটা ছোট্ট জেলা হওয়ার পরও টাঙ্গাইলের একটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ছিল। রাজনীতি, সংস্কৃতির কেন্দ্রস্থল টাঙ্গাইল অনেক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এই শহরে বসন্ত উৎসব উদযাপন হতো। সেই বসন্ত উৎসবে নাচ-গান ছাড়াও গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্যও স্থান পেত। করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ছাড়াও বেশ কয়েকটি নাট্যদলও গড়ে উঠেছিল, তারাও নাটক করত এবং টাঙ্গাইলের নাট্যামোদী জনগণের কাছে খুবই ভালোবাসার পাত্র ছিল। এই শহরে সেতার, বেহালা, তবলাসহ উচ্চাঙ্গ সংগীতের বেশ কিছু গায়ক-গায়িকার সমাবেশ ঘটেছিল। আবার দুর্দান্ত সব অভিনয়শিল্পী নাটককে জীবন্ত করে রাখতেন। এই শহর ছিল আধুনিক কবিদের পীঠস্থান। যেহেতু ঢাকার সঙ্গে ১৯৬২ সাল থেকেই বাস যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল, মাত্র দুই টাকা ভাড়ায় ঢাকায় আসা যেত। কবিরা প্রায়ই টাঙ্গাইলে এসে আনন্দময়ী কেবিনে কবিতার আসর বসিয়ে ঘোষণা করতেন, কবিতাই পারে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে ঠেকাতে। সেই রকম একটা আবহের মধ্যে টাঙ্গাইল শহরটি শাড়ি, চমচম এবং মধুপুরের গজারির বন নিয়ে খুব গর্বের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসের সঙ্গে টাঙ্গাইলের লোকজন যুদ্ধ করেছে, কাদের সিদ্দিকী বঙ্গবীর হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে তাঁর সমর্পিত অস্ত্রকে তুলে নিয়েছেন।


মুক্তিযুদ্ধের পর টাঙ্গাইল কখনও উজ্জ্বল, কখনও বিষণ্ণ হয়েছে। সামরিক শাসনের জাঁতাকল টাঙ্গাইলের ওপর দিয়ে গেছে। তবুও টাঙ্গাইল একটা রাজনীতি ও সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র হিসেবে বহাল থেকেছে। এর মধ্যে একটা নতুন সংস্কৃতি টাঙ্গাইলকে গ্রাস করল। সেটি হচ্ছে দোকান সংস্কৃতি। রাস্তার দুই পাশে এবং ফাঁকা জায়গাগুলোতে কোথাও এতটুকু জায়গা নেই। শুধু দোকান আর দোকান। কোথাও এই দোকানগুলো মহিমান্বিত হয়েছে সুপারমার্কেট হিসেবে। দোকানগুলোর পেছনে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ আছে বটে। কিন্তু প্রধান উদ্যোক্তা পৌরসভা প্রথম আঘাত হানে খালটির ওপর। দৃষ্টিনন্দন ও পয়ঃপ্রণালির কাজ করা খালটির ওপর একের পর এক সুপারমার্কেট গড়ে ওঠে। এটি শহরের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের ওপর নির্মম আঘাত। পৌরসভার মেয়র যিনি থাকেন তিনি দোকান করার একটা পরিকল্পনা নিয়ে নামেন। প্রচুর দোকান হয়, সেগুলো বিলি-বণ্টন প্রক্রিয়ায় প্রচুর টাকা-পয়সার লেনদেন হয় এবং মেয়র হিসেবে কেউ বিদায় নিলে অন্য মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পরপরই আবার নতুন জায়গা খুঁজতে শুরু করেন। শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হয়, পৌরসভার অন্যান্য কার্যক্রম থিতিয়ে পড়ে। কিন্তু দোকান সংস্কৃতি সবকিছুকে ছাপিয়ে শহরকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর মধ্যে রিকশা শহরের একমাত্র অভ্যন্তরীণ পরিবহন কিন্তু তার জায়গা দখল করে ফেলে চীন থেকে আমদানীকৃত বিদ্যুৎচালিত ইজিবাইক। শত শত ইজিবাইক শহরটাকে গ্রাস করে ফেলেছে। এই ইজিবাইকের লাইসেন্সদাতা হচ্ছে পৌরসভা। পৌরসভা রাস্তার ক্ষমতা বিবেচনা না করে একের পর এক ইজিবাইকের লাইসেন্স দিয়ে থাকে। একবার এক মেয়র ইজিবাইক চালানোর জন্য সময় ভাগ করে দিয়েছিলেন। সেই সময় ভাগ এখন আর নেই। দোকান সংস্কৃতি শহরটাকে এমনভাবে গ্রাস করেছে, সেই নিঝুম-নিরালা পাবলিক লাইব্রেরিটি নিচতলা থেকে ওপরের তলায় উঠেছে। নিচে আবারও দোকানপাট।


সেই টিনের ঘরের করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব আর নেই। দালান উঠেছে, সঙ্গে একটি মঞ্চ ও সিনেমা হল ছিল, তা উঠে গিয়ে সেখানেও এসেছে অসংখ্য দোকান। সেই ঘ্যাগের দালান, যার নিচতলায় ছিল একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্ট- নাম নিরালা। যে কারণে বলা হতো নিরালার মোড়। শুনেছিলাম শহরের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এখানে ভাস্কর্য হবে এবং মনোরম কিছু স্থাপনা হবে। এখন শোনা যাচ্ছে, সেই জায়গায় পৌরসভার উদ্যোগে ১৪ তলা শপিং কমপ্লেক্স হবে। নিরালার মোড় থেকে জেলা শহরের দিকে যেতে রাস্তার দু'পাশে আবাসিক গৃহগুলো এখন পৃথিবীর বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শোরুমে পরিণত হয়েছে। শহরে নিশ্চিন্তে আনন্দদায়ক কোনো ভ্রমণ এখন কল্পনা করা যায় না। ইজিবাইক, রিকশা, প্রাইভেটকার, ট্রাক এসবের ভিড় এত প্রবল যে, কোনো পথই আর পথিকের নেই। নিরালার মোড় থেকে দক্ষিণ দিকে থানা ও শান্তিকুঞ্জ কাচারিতে যেতেও অসংখ্য দোকান। পশ্চিম দিকে গোরস্তান এবং টাঙ্গাইলের শেষ সীমানা একটা ব্রিজ পর্যন্ত ইজিবাইক, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও রিকশার জ্যামে কখনও আটকে থাকতে হয়। পথ সম্প্রসারণেরও কোনো জায়গা নেই বা পৌরসভার পরিকল্পনাও নেই।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

সংবাদ সূত্র

News

The Largest News Aggregator
in Bengali Language

Email: [email protected]

Follow us