আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনে ধর্মের নামে উন্মাদনা যত বাড়ছে, ধর্ম পরিচয়ের ভিত্তিতে পারস্পরিক ঘৃণা-বিদ্বেষ-হিংসা যত বাড়ছে তত বেশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনাদর্শ ও সংগ্রামকে গভীরভাবে উপলব্ধি করার গুরুত্ব বাড়ছে। বর্তমানে আমাদের সমাজ ধর্মান্ধতার যে জায়গায় উপনীত হয়েছে, তা বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শের ঠিক বিপরীত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও সারাজীবনের সংগ্রামই ছিল বাঙালির জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে তিনি ধাপে ধাপে নিয়ে গেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ধারণায়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি হিসেবে তাকে সন্নিবেশ করেছেন।
কিন্তু যারা পাকিস্তানপন্থি, যারা একাত্তরে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধিতা করেছে, যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারেনি, তারা চুপচাপ বসে থাকেনি। তারা চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে। এজন্য তারা সুযোগ খুঁজেছে। সেই সুযোগ তারা পেয়ে যায় ১৯৭৫ সালে। একদল কুচক্রী সেনা সদস্য জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররোচনায় বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে তাদের অতৃপ্ত বাসনা চরিতার্থ করার সুযোগ পেয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে পাকিস্তানি ধারণা সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় রাজনীতিকে আবার ফিরিয়ে এনেছে।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরই সামরিক শাসকরা রাজনৈতিক সমর্থন জোগাড় করার জন্য এই ইসলামপন্থিদের সঙ্গে নিয়ে কিছু বামপন্থিকে কাছে টানতে শুরু করে। এ ব্যাপারে মূল ভূমিকা পালন করেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের বদলে আমদানি করলেন ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। তার সময়ই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ফিরে আসে। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়। হারিয়ে যেতে থাকে বঙ্গববন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ।
“শেখ মুজিবুর রহমান কেবল জাতির জনক ছিলেন না, নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ প্রভাবশালী এবং জনপ্রিয়। তিনি যত দিন জীবিত ছিলেন, তত দিন অন্তত সংবিধান অনুযায়ী ধর্মনিরপেক্ষতা তত্ত্ব বজায় ছিল। আইনত আমাদের পরিচয় ছিল আমরা ‘বাঙালি’। কিন্তু তিনি যখন ফৌজি বাহিনীর বিদ্রোহী কিছু কর্মকর্তার হাতে নিহত হন, তখন ধর্মনিরপেক্ষতা থেকে ধর্মীয় পরিচয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়।” (গোলাম মুরশিদ, ‘স্বরূপের সংকট, না নব্য-সাম্প্রদায়িকতা’ ‘উজান স্রোতে বাংলাদেশ’ ২০০৩ সাল, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা)।
এর ধারাবাহিকতাতেই আরেক সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদ সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করেছিলেন। তখন রাজনীতিতে এক নতুন ‘চেতনা’ আমদানি করা হয় তা হলো ভারতবিরোধিতা। ‘ভারত বিধর্মীদের দেশ, তারা বাংলাদেশকে গ্রাস করতে চায়, মুসলিমদের পদানত করতে চায়’ এমন একটা প্রচারণার মাধ্যমে ভারতবিরোধী রাজনীতি চাঙা করে তোলা হয়। ভারত ও হিন্দু বিরোধিতার রাজনীতি জোরদার হওয়ায় ক্রমেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। পরবর্তী সময়ে খোদ আওয়ামী লীগও এই ধর্মনিরপেক্ষতার পথ থেকে আস্তে আস্তে দূরে সরে যায়। অথচ স্বাধীন দেশে যে সংবিধান ১৯৭২ সালে প্রণীত হয়েছিল তাতে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এবং সব ধরনের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল রাষ্ট্রীয়ভাবে।