কোনো ধরণের গণশুনানি, পূর্বালোচনা ছাড়াই হঠাৎ ঘোষণায় জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়েছে সরকার।
ডিজেল ও কেরোসিন লিটারে ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ৮০ থেকে ১১৪ টাকা, অকটেন লিটারে ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ৮৯ থেকে ১৩৫ টাকা, পেট্রল লিটারে ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ৮৬ থেকে ১৩০ টাকা করা হয়েছে।
আজ শনিবার ভোররাত ১২টা থেকে এই নতুন দাম কার্যকর করা হয়েছে।
বিশ্ব বাজারে জ্বালানি তেলের দাম যখন কমছে, সেই সময়ে বাংলাদেশে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানতে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ এবং জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেনের সঙ্গে।
অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সরকারের এই সিদ্ধান্তের একটা ধারাবাহিকতা আছে। বিশ্ব বাজারে তেলের দাম যখন বেশি ছিল না তখন থেকেই দেশে তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল।'
তেলের দাম বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'জনগণের দিক থেকে দেখলে এর জন্য কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। সরকার দাবি করছে, বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়ানো হলো। কারণ, সরকারের পক্ষে আর ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব না। এই দাবির পেছনে কোনো যুক্তি পাওয়া যায় না।'
যুক্তি কেন পাওয়া যায় না সেই ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, 'ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গত কিছু দিনে তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকলেও বিশ্ব ব্যাপী মন্দার আবহাওয়া তৈরি হওয়ায় তেলের দাম কমে যাচ্ছে। একই কারণে সামনে তেলের দাম আরও কমে যাবে। কাজেই বিশ্ব বাজারে তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে আমাদের দেশে তেলের দাম বাড়ানোর যুক্তি কোনোভাবেই প্রাসঙ্গিক না।'
অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, 'আমাদের দেশে প্রশাসনিক দামের বিষয়টি অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ, তারা নিজেরাই বসে নিজেদের মতো করে আলোচনা করে সার্বিক দিক বিবেচনায় দাম নির্ধারণ করেন। বিশ্ব বাজারের সঙ্গে এলপিজির দাম সমন্বয়ের বিষয়ে আমি প্রশ্ন করেছিলাম। কিছুদিন আগে এলপিজির দাম খুব বেড়ে গিয়েছিল, মাঝে কমেছে, আবার কিছুদিন আগে অনেক কমে গেছে। এটা জনগণ মেনে নিয়েছে। কারণ, তারা দেখতেই পাচ্ছে বিশ্ব বাজারে দাম কেমন রয়েছে।'
'আমি মুখ্য সচিবের কাছেও আমি প্রশ্ন করেছিলাম, বিশ্ব বাজারের সঙ্গে দাম সমন্বয়টা এলপিজির মতো কেন হলো না? সমন্বয়ের কথা বললে, সেটা সময় সময়ই হোক। তাহলে বিশ্ব বাজারে দাম কমলে আমার দাম কমবে, বাড়লে আমি বেশি দাম দিব। ভারতে এটা বেশ ভালো ভাবেই করছে।'
'প্রশাসনিক দাম যখন বলছি, তখন সামাজিক বিবেচনায় এই দাম নির্ধারণ হওয়ার কথা। সামাজিক বিবেচনায় কেউ এমন উচ্চ মূল্য নির্ধারণ করতে পারে না। সামাজিক বিবেচনায় সবসময় ভর্তুকি দিতে হবে যখন অতিরিক্ত দাম বেড়ে যাবে। সেটাই প্রশাসনিক দাম। জনগণের কষ্ট হবে, আমাদের মতো দেশের মানুষ সেটা সহ্য করতে পারবে না—সেই বিবেচনায় বিশ্ব বাজারের দরে দাম নির্ধারণ হয় না। যদি বিশ্ব বাজারে দাম কমে যায়, তখন সেটা সরকারের সিদ্ধান্ত যে দাম কমাবে নাকি আগের মতোই রাখবে। কিন্তু প্রশাসনিক দাম ধরে জনগণকে এভাবে চাপ দিব, সেটাতো নীতির বিরুদ্ধে চলে যায়।'
তিনি আরও বলেন, 'ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে আমরা তৈরি করেছি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিইআরসির আওতায় পরলেও সরকার তাদের হাতে তেলের দাম নির্ধারণের বিষয়টি দেয়নি, নিজের হাতে রেখেছে। এর কারণ হিসেবে বলেছে, মানুষের যেন কষ্ট না হয় তার জন্য তারা এই ক্ষমতাটা তাদের হাতে রেখেছে। কিন্তু, আজ দেখছি তারা এর বিপরীতটা করল।'