এ বছর নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে, বিশেষত সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাঙালি সংস্কৃতি বনাম হিন্দুয়ানি সংস্কৃতি বিষয়ক একটি বিতর্ক কিংবা বলা যেতে পারে কুতর্ক, বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। এটি নিয়ে আগেও যে বিচ্ছিন্নভাবে নানা মহল থেকে নানা কথা বলা হয়নি তা নয়, তবে এবার মনে হলো একটি গোষ্ঠী খুব সংগঠিতভাবেই মাঠে নেমেছে বাঙালির বহু শতাব্দী ধরে চর্চিত লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ধর্মের একটি কল্পিত বিরোধকে পাকাপোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করার মতলব নিয়ে। বিতর্কটি মঙ্গল শোভাযাত্রায় ব্যবহৃত কয়েকটি নিরীহ প্রাণীর প্রতীকী চিত্র নিয়ে শুরু হলেও দ্রুতই সেটি বাঙালির চিরন্তন কিছু খাদ্যাভ্যাস, পোশাকপরিচ্ছদ, আচার-অনুষ্ঠান এমনকি চিরচেনা কিছু পুষ্প, বৃক্ষের শেকড় ধরেও টান মারে। অথচ পুরো বিতর্কের মূল ভিত্তিটিই নিতান্ত দুর্বল, কেননা এখানে সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের বিচার কিংবা তুলনা করা হচ্ছে, যে-দুটো পুরোপুরি দুই ভিন্ন গোত্র কিংবা বর্গের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাসের বিষয়, যা মূলত পরকালকেন্দ্রিক, আর সংস্কৃতি জীবনাচারের বিষয়, যার কার্যকর্ম ইহকালভিত্তিক। সংগঠিত ধর্মের উৎপত্তি কিংবা প্রচলন মানবেতিহাসের তুলনামূলকভাবে খুব নতুন একটি বিষয়, বড়জোর পাঁচ কি ছয় হাজার বছর আগের; যেখানে সংস্কৃতি খোদ মানবজাতির সমান বয়সী, লক্ষ কোটি-বছরের মাপে যার হিসাব চলে। ধর্ম পরিবর্তনশীল, সেই তুলনায় সংস্কৃতির মোটামুটি একটি স্থায়ী রূপ বিদ্যমান।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর কথাই ধরা যাক। তার বয়স সাকুল্যে হাজার বারোশ বছর; এর আগে সে ছিল মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ও নিম্নবর্গের হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত, তার আগে প্রধানত সনাতন ধর্মাবলম্বী, আর তারও আগে প্রাণী ও প্রকৃতিপূজারী। কিন্তু সংস্কৃতির কথা যদি বলি, তার মূল ভিত্তিভূমিটি কিন্তু আমাদের প্রকৃতিপূজারী পর্ব থেকে অদ্যাবধি প্রায় একইরকম রয়ে গেছে; হয়তো পারিপার্শ্বিক, আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রভাবে তাতে কিছু বাহ্যিক বদল কিংবা যোগবিয়োগ ঘটেছে, যার পেছনে ধর্মচর্চারও কিছুটা ভূমিকা নিশ্চয়ই রয়েছে। কিন্তু তাই বলে প্রতিবার ধর্মবদলের সঙ্গে সঙ্গে তার অনুসারীদের প্রাত্যহিক জীবনাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবকিছুই একেবারে আগাপাশতলা পালটে যায়নি বা যায় না। সে আগে যে ভাষায় কথা বলত, যে খাবার খেত, যে পোশাক পরিধান করত, যে গান গাইত, যে খেলা খেলত, যে উৎসব পালন করত, যেভাবে ঘর সাজাত, বাগান করত, প্রাণী পুষত, প্রতিবেশীর সঙ্গে মিলত, এক কথায় তার দৈনন্দিন জীবনযাপন করত, তার পুরোটাই প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। পালটায় মূলত নতুন ধর্মের রীতিনীতি অনুযায়ী তার প্রার্থনা, উপাসনার পদ্ধতি-প্রকরণ আর তার সঙ্গে সম্পৃক্ত অল্পস্বল্প খাদ্য, পরিধেয় সম্পর্কিত আচার-অভ্যাস। তা-ও সেসব কেবল ধর্মবিশ্বাসীদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, অন্যদের ক্ষেত্রে অতটা নয়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতির মধ্যে স্পষ্টতই একটি বিভাজন রয়েছে; ধর্ম নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখে তার বিশ্বাস ও সেইসূত্রে পালনীয় আচার-অনুষ্ঠানের সীমিত পরিসরে, অন্যদিকে সংস্কৃতি তার জীবনের ব্যাপক ও বৃহত্তর পরিধিতে নিরন্তর ক্রিয়াশীল থাকে, থাকে তার নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের প্রধানতম স্মারক ও চালক হিসেবে।