ভয়াবহ নিষ্ঠুরতার মঞ্চায়ন হয়ে গেল ঢাকার বুকে। এক পক্ষে নিউমার্কেট ও আশপাশের কয়েকটি মার্কেটের দোকানি ও কর্মচারী; অন্য পক্ষে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী (বিলুপ্ত কমিটি) ও ছাত্ররা। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পক্ষে-বিপক্ষে বেশুমার আদম। ছবি ও ভিডিও শেয়ার করে, ক্ষণে ক্ষণে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজ নিজ পক্ষকে সমর্থন জোগানো। স্নায়ুক্ষয়ী উন্মাদনার দীর্ঘ কয়েকটি ঘণ্টা।
বাংলাদেশ যেন ইতিহাসের উল্টো চাকায় ঘুরতে ঘুরতে ফিরে গেল আড়াই হাজার বছর আগের গ্রিসে। স্টেডিয়ামভর্তি যেন উন্মাদ দর্শক (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা)। সুসজ্জিত আর সুরক্ষিত মঞ্চে বসে আছেন রাজন্য আর অমাত্যরা (মন্ত্রী, এমপি, আমলা, ব্যবসায়ীনেতা, পুলিশ কর্মকর্তা, নাগরিক সমাজ)। মাঠে মুখোমুখি গ্লাডিয়েটররা (দাসসমাজে দাসদের রক্তক্ষয়ী গ্লাডিয়েটর খেলায় বাধ্য করা হতো। কিন্তু এখানে স্বেচ্ছায় কিংবা প্ররোচিত হয়ে অংশ নিয়েছে)। একদল আরেক দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য মরিয়া। ইট, লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠিসোঁটা ও রামদা নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এক পক্ষ দল বেঁধে সাংবাদিকদের মাথা ফাটাচ্ছে, রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুর করছে। আরেক পক্ষে হেলমেট বাহিনী। ইটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়া দুই তরুণকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করছে। ঘৃণা আর নৃশংসতায় নিজেকেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা।
প্রবল উন্মত্ততা আর আত্মবিনাশের সময়গুলো একসময় থিতু হয়ে আসে। ঘৃণা ও নৃশংসতার বলি হয় দুই তরুণ। এমন তুচ্ছ বিষয়ে এমন করে তরুণদের জীবনহানি আর কোথাও কি ঘটতে পারে? ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন করলেই কেন এমন বোধশূন্য নৃশংস হয়ে ওঠে তরুণেরা? ২০ বছরের তরুণ নাহিদ, যাঁর বিয়ে হয়েছিল কয়েক মাস আগে। প্রিয়তমা স্ত্রীর হাত থেকে মেহেদির রংই শুকায়নি, রামদা দিয়ে কুপিয়ে তাঁকে হত্যা করা হলো। আরেক তরুণ মুরসালিন। ২৪ পেরিয়েছিলেন। দুই শিশুকন্যা। তাঁর শরীরেও অসংখ্য আঘাতের ক্ষত। দুজন ছাত্র গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। কমবেশি আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই পক্ষের কমপক্ষে ২০০ জন। এই রক্তক্ষয় ও সংঘাতের মধ্য দিয়ে অর্জনটা কী হলো? তরুণদের মধ্যে এই সর্বনাশা হিতাহিত বোধশূন্যতা, বিভাজন-ঘৃণা আর নৃশংসতার যে সংস্কৃতি দানা বেঁধেছে, তারই কারণ কী? যে ছাত্ররা বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে একসময় পথ দেখিয়েছে, তাদেরই একদল উত্তরসূরি দুই দোকানকর্মীর মধ্যেকার ঝগড়ায় ভাড়াটে হিসেবে গেছে মাস্তানি করতে। এর থেকে নৈতিক পচন, সর্বনাশা অধঃপতন আর কী হতে পারে?
১৯৪৭ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্র-তরুণদের সঙ্গে কৃষক-শ্রমজীবীদের অভূতপূর্ব সংহতি আমরা দেখেছি। ছাত্রদের কিছু হলে শ্রমজীবীরা দলে দলে রাস্তায় বের হয়ে তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ১৯৫২ সালের আমাদের যে গৌরবজনক ভাষা আন্দোলন, আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূচনাবিন্দু, তাতে ছাত্রদের সঙ্গে কৃষক ও শ্রমজীবীরা যুক্ত হওয়ায় অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। একই ধারাবাহিকতা আমরা দেখেছি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে।
কিন্তু এরপরে সমাজে গভীর যে বিদ্বেষ ও বিভাজনের ক্ষত তৈরি হয়েছে, তার পেছনে গত তিন দশকের আর্থরাজনৈতিক ব্যবস্থার দায় কতটুকু, সে প্রশ্ন করা জরুরি। বিশেষ করে গত এক যুগে দেশে যে এককেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা, সামাজিক অসহিষ্ণুতার পেছনে তার প্রভাবটা খুঁজে বের করা সবার জন্যই মঙ্গলজনক। সমাজে নানা মত, নানা পথ থাকবে। সেটাই স্বাভাবিক। নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার সুযোগ থাকলে স্বাভাবিক রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তরুণেরা নিজেদের চিন্তা চর্চার সুযোগ পায়। কিন্তু তাদের যদি অবরুদ্ধ করে রাখা হয়, ঠেসেঠুসে একটা রাজনৈতিক চিন্তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে তার ফলাফল ভয়াবহই হতে পারে।