বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পেছনে যে কতগুলো সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ছিল, এর মধ্যে অন্যতম সমাজের সর্বস্তরে সাম্য প্রতিষ্ঠা। অর্থাৎ বৈষম্য বিলোপের প্রত্যয়টা তখন আমাদের সামনে ছিল অগ্র কাতারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্যের আকাঙ্ক্ষা এখনও পূরণ হয়নি। সমাজের নানা স্তরে অর্থনৈতিক, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নানা দিকে এখনও ছায়া রয়ে গেছ বৈষম্যের। এ বৈষম্য নিরসনে বিগত ৫০ বছরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রচেষ্টা চলেনি, তা নয়। এই প্রচেষ্টা এখনও চলমান এবং রাষ্ট্রের নীতিনির্ধাকরদের চিন্তায় তা যে সক্রিয়- এর ফের প্রমাণ পাওয়া গেল জাতীয় সংসদে 'বৈষম্যবিরোধী বিল-২০২২' উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে। গত ৫ এপ্রিল বিলটি উপস্থাপিত হয়েছে এবং বিলটি সংশ্নিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পর্যালোচিত হচ্ছে। কমিটিকে ৩০ দিনের মধ্যে বিলটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমি মনে করি, এ পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম সমাজে বিদ্যমান অসংগতিগুলোর দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে সম্পন্ন করা প্রয়োজন।
সংবিধান অনুসারে বাংলাদেশের সব নাগরিক আইনের চোখে সমান। ধর্ম, বর্ণ, জাতি বা জন্মস্থান নয়; একজন মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সর্বক্ষেত্রে সমানাধিকার ভোগ করবেন; ন্যায্য-ন্যায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হবেন- সংবিধানের ২৮ (১) অনুচ্ছেদে তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের এই বিধানের বাস্তব প্রতিফলনে যে আইন প্রয়োজন, তা এখন পর্যন্ত আমাদের নেই। উপস্থাপিত বিলটি সেই পথরেখা সৃষ্টি করেছে। সরকার এ জন্য সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার। সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ব্যাপারে এই বিলে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে, তাও অত্যন্ত সময়োপযোগী আলোকপাত বলে মনে করি।
এও সত্য, আমাদের দেশে জনকল্যাণ নিশ্চিতকল্পে অনেক আইন থাকলেও এসব আইনের প্রয়োগ ও বাস্তবায়ন নিয়ে নানা মহল থেকে অতীতে নেতিবাচক কথা শোনা গেছে। এত কিছুর পরও আশার কথা হলো, ভুক্তভোগীদের প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে যে মনিটরিং কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাতে বৈষম্য নিরসনে কর্মরত বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিদের রাখার পাশাপাশি নিম্নবর্গ শ্রেণি থেকে প্রতিনিধিও সংযুক্ত করা হয়েছে। মনিটরিং কমিটির ক্ষমতা, কাজের পরিধি, প্রতিকারের প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে কোনো কোনো মহল থেকে কিছু বিষয় সুনির্দিষ্ট করে যে আলোচনা হয়েছে, এসবই সংসদীয় কমিটির পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রমে আমলে রাখা দরকার। আমাদের সমাজে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও একই সঙ্গে দীর্ঘসূত্রতা নিয়ে কথা আছে। এ ক্ষেত্রে যে এর ছায়া না পড়ে, আমরা তা-ই চাইব।
চলতি বছরের শুরুর দিকে কয়েকটি গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল, বাংলাদেশের শহরগুলোতে ধর্ম, উপার্জনের সক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা বিষয় ঘিরে গত এক দশকে তাদের ভাষায় আশঙ্কাজনক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। তারা বলেছে, মানুষে মানুষে বিভাজন-বৈষম্য বাড়ছে। তাদের এই গবেষণা আমলে নিলে বিদ্যমান সমস্যা নিরসনে সহায়ক হতে পারে। আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বৈষম্য নিয়ে নানা কথাই হয়ে থাকে। বিশেষ করে করোনা-দুর্যোগ প্রসঙ্গটি আরও সামনে নিয়ে এসেছিল। করোনার দাপট এখন ম্রিয়মাণ বলা চলে। কিন্তু এর অভিঘাতে সমাজে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা উপশমে সময় লাগবে। সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়িয়েছে বটে কিন্তু সরকারের এসব কর্মসূচি যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদের কারও কারও বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে সংবাদমাধ্যমে অনিয়ম-দুর্নীতি-অস্বচ্ছতার অভিযোগ কম ওঠেনি।