পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খান আকস্মিকভাবে জাতীয় সংসদের নির্বাচন স্থগিত করলে বঙ্গবন্ধুর তাৎক্ষণিক ঘোষণায় ৩ মার্চ ’৭১ রংপুরে হরতাল পালিত হয়। হরতালের মিছিলে গুলির ঘটনায় কিশোর শংকু সমজদারসহ ৩ জন শহীদ হয়। এরপর ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে স্বাধীনতার ঐতিহাসিক আহ্বানে এখানকার মানুষ প্রস্তুত হতে থাকে সশস্ত্র সংগ্রামের পথে। তারই ফলে ২৪ মার্চ সম্মানীপুরের শাহেদ আলীর নেতৃত্বে অতর্কিত গেরিলা হামলায় লে. আব্বাস ও অপর তিনজন পাকিস্তানি সেনার আহত হওয়ার ঘটনায় (আহত লে. আব্বাস পরে মৃত্যুবরণ করেন) রংপুরের মানুষ আরও সাহসী হয়ে ওঠে। ২৮ মার্চ এলাকার হাজার হাজার মানুষ স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র (বাঁশের লাঠি, বল্লম, তীর-ধনুক ইত্যাদি) নিয়ে দুঃসাহসিক অভিযান চালায় রংপুর সেনানিবাসে যা ছিল অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয়। মনে হয়েছিল এ যেন গণজাগরণের ইতিহাসে ফরাসি বিপ্লবের ‘বাস্তিল দুর্গ’ অভিযানের এক দৃশ্যমান নব সংস্করণ। আমি নিজেও সেই অভিযানের এক গর্বিত অংশীজন।
ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে অকার্যকর করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ দৃশ্যমান হওয়ায় পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এসময় রেল ও সড়ক যোগাযোগের স্পর্শকাতর ব্রিজগুলো পাহারার ব্যবস্থা করে। আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় এক মাইল দূরে একটি রেলওয়ে ব্রিজ (‘গাড়ার কুড়া’ ব্রিজ নামে পরিচিত) পাহারার জন্য কর্তৃপক্ষ দশজন রাজাকার মোতায়েন করে। রাজাকার মোতায়েনের পর স্থানীয়দের জন্য এই পথ পরিত্যক্ত হয়ে যায়। কিন্তু জহীর খলিফার (দর্জি) মতো দুএকজন ‘দিন আনা দিন খাওয়া’ লোককে ভয়ের ভয়াল ছোবল উপেক্ষা করেই বেরিয়ে পড়তে হয় পেটের ধান্দায়, অনেকটা জীবন বাজি রেখেই। প্রথম দিন ব্রিজ পার হতে গিয়ে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে জহীর সাহেবকে। পাহারারত রাজাকাররা তার বয়স, অবয়ব ও বেশভূষা এবং কথাবার্তা শুনে তেমন ক্ষতিকারক নয় মর্মে পরীক্ষামূলক যাতায়াতের অনুমতি দেয়। রাজাকার কমান্ডার মাঝে মাঝে তার সঙ্গে গল্পসল্প করেন এবং তার পরিবারের খোঁজখবর নেন। জহীর সাহেব সরল মানুষ, প্রশ্নের মুখে পরিবারের অনেক কথাই বলতে বাধ্য হন। সুন্দরী বলে বড় দুই মেয়ের ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে, এখনো দুই বিবাহযোগ্যা মেয়ে ঘরে প্রসঙ্গক্রমে এ কথাও তিনি বলে ফেলেন। এরপর রাজাকার কমান্ডার নিজেই তার বাড়িতে দাওয়াত চেয়ে নেন। দাওয়াত খেয়ে আসার পর কমান্ডার সাহেব একদিন দর্জির ৩য় মেয়ে মিনিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। জহীর সাহেব বেকায়দায় পড়ে যান। অন্যদিকে জহীর সাহেবের বাড়িতে রাজাকার কমান্ডারের দাওয়াত খাওয়ার ব্যাপারটি এলাকায় জানাজানি হয়ে পৌঁছে যায় এলাকা দাপিয়ে বেড়ানো ডাকাত দলের কাছেও। একদিন রাতে ডাকাত দলের কয়েকজন ভাটিয়া পাড়ায় জহীর সাহেবের বাড়িতে গিয়ে খাবার আয়োজন করতে বলে। এরপর ডাকাতের সর্দার জহীর সাহেবকে বলেন যে, সেদিনই তার মেয়ে মিনিকে দিয়ে দলের সদস্য জিকরুলের বিয়ে দিতে হবে। জহীর সাহেবের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। তিনি এক সপ্তাহ সময় চেয়ে নেন। পরদিন জহীর সাহেবের ছেলে শহীদুল, আমাদের স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, আমাদের কাছে এসে সবিস্তারে সব ঘটনা খুলে বলে।