কতগুলো ফর্মুলা অস্বীকার করা যায় না। উনিশ শতকে কাশ্মীরের ব্যবসায়ীদের ঢাকার নবাব হয়ে ওঠাটা সহজ ছিল না। ব্রিটিশরাজের কাছ থেকে ‘নবাব’ উপাধি পাওয়ার পেছনেও দূরদর্শী চিন্তা ছিল নবাব আবদুল গনির। কিন্তু এর ভিত্তিটি নবাবদের অন্যতম পূর্বপুরুষ খাজা হাফিজউল্লাহ করে দিয়েছিলেন।
পীর হিসেবে খ্যাত হাফিজউল্লাহ মৃত্যুর আগে বংশধরদের মূল্যবান পরামর্শ দিলেন। বললেন, চামড়া ও লবণের ব্যবসা করে অনেক টাকা হয়েছে। এবার আভিজাত্য কিনতে হবে। বললেন, আর ব্যবসা নয়। জমানো টাকা দিয়ে প্রধানত চরাঞ্চলে অনেক জমি কিনবে। আর জমিদারি সবল করার জন্য যে অঞ্চলে কৃষক-প্রজা বেশির ভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের, সেখানে নায়েব নিযুক্ত করতে হবে মুসলমান। আর মুসলমান প্রজা বেশি হলে নায়েব নিযুক্ত করবে হিন্দু সম্প্রদায় থেকে। এতে পক্ষপাতিত্বের সুযোগ না থাকায় খাজনা আদায় কঠিন হবে না।
বণিক প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির হাতে ঔপনিবেশিক শাসন চালাতে গিয়ে ব্রিটিশ শাসকরা টের পেয়েছিলেন, ব্যবসায়ী শাসকদের দিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ঘটনাচক্রে বাংলার শাসনক্ষমতায় এসেছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি। ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনে প্রধান কৌশল হচ্ছে উপনিবেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে দেশবাসীর মনোরঞ্জন করা। মানুষকে তুষ্ট রেখে কৌশলে এ দেশের সম্পদ পাচার করতে হবে। কিন্তু বণিক শাসকরা এসব উপদেশ মনে রাখতে পারেননি। বণিক স্বার্থ শুধু পুঁজি বাড়াতে ব্যস্ত। তাদের প্রজা শোষণ স্পষ্ট হয়ে পড়ে। অবশেষে মানুষের ক্ষুব্ধতার বহিঃপ্রকাশে ১৮৫৭ সালের বিপ্লব সংঘটিত হয়। এবার ব্রিটিশরাজ বুঝতে পারে, বণিক স্বার্থ কোনো নিয়ম মানে না। তাই ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনের অবসান ঘটিয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল।
একই ভুলের আবর্তে ঘুরছে যেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সরকার। সম্ভবত অনেক রাজনীতিকের অনেকের মধ্যে সততা ও দৃঢ়তার অভাব থাকায় এবং দলের অর্থের প্রয়োজনে ব্যবসায়ীদের জায়গা করে দেওয়া হয় রাজনীতিতে। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রিত্বও পেয়ে যান তাঁরা। উনিশ শতকের হাবিবুল্লাহর মতো দূরদর্শিতা দেখাতে না পারায় আখেরে প্রমাণ হলো, বণিক বণিক স্বার্থই রক্ষা করে। জনকল্যাণ গৌণ হয়ে যায়।
এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দশাও অনেকটা এ রকম। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার কথা জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির পীঠস্থান, সেখানে রাজনৈতিক দল ও সরকারগুলো দলীয় রাজনীতি চর্চার ক্ষেত্রভূমি বানিয়ে ফেলল শিক্ষাঞ্চলকে। দলীয় সরকারগুলো কার্যত এখন চাচ্ছে না মুক্ত বিবেকের বিকাশ ঘটুক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের ক্ষমতাবান অংশকে নষ্ট রাজনীতির আরকে বুঁদ করে ফেলা হয়েছে। তাই এখন সুস্থ ধারার রাজনীতির পরিবেশ না থাকায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা রাজনীতিবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। জাতীয় নেতৃত্ব নিজেদের দলীয় স্বার্থ ধরে রাখার জন্য তল্পিবাহক ছাত্র-ছাত্রীদের দুর্বৃত্ত, চাঁদাবাজ আর খুনি বানিয়ে ফেলছে। নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির মেধাবী সর্বজনশ্রদ্ধেয় ও পণ্ডিত শিক্ষকদের আর এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে দেখা যায় না। তার বদলে রাজনীতির তল্পি বহনে যোগ্যতা প্রদর্শন করে এবং তদবিরের যোগ্যতায় ভিসি হয়ে যাচ্ছেন অনেকে। আর এ ধারার ভিসি নিয়োগ করে স্বস্তি পায় রাজনৈতিক সরকারগুলো।